এক ব্যাংকে গিয়েছি নিজের কাজে। সামনে বসে থাকা সবাই নারী কর্তা। পুরুষ কেবল দুজন। হঠাৎ দেখি, এই দুজন সবার সামনেই ঝগড়া শুরু করে দিয়েছেন। একজন উঁচু গলায় আরেকজনকে বলছেন, ‘স্যার, আপনি কি চোখে দেখেন না? আমার কম্পিউটার তো নষ্ট হয়ে আছে। আমি কাজ করব কীভাবে?’ স্যার ভদ্রলোক অন্য পাশে আরও উঁচু গলায় বলছেন, ‘কম্পিউটার নষ্ট তো কী হয়েছে? হাতে কাজ করা যায় না? অন্য কাজ করলেই তো হয়।’
এই দুই ভদ্রলোক এরপর মিনিট পাঁচেক এভাবেই ঝগড়া করেছেন। তাঁদের গলা উঁচু হতে হতে এমন অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে, আমি ভাবছিলাম, এই না মারামারি শুরু হয়! ভাগ্য ভালো, এমন কিছু হয়নি। খানিক বাদে ব্যাংকের অন্য কর্মীরা এসে তাঁদের ঝগড়া থামান। এই অফিস থেকে বের হওয়ার সময় ভাবছিলাম, তাঁরা নিশ্চয় এরপর একে অপরের সঙ্গে একজীবনে কথা বলবেন না! কে জানে, হয়তো মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয় কি না! যে ঝগড়াটাই না করলেন।
গতকালই পাশের বাসায় থাকে এক তরুণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পাস করে বছর তিনেক বসে আছেন ঢাকায় চাকরি পাওয়ার আশায়। এখনো তেমন কোনো চাকরি জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলছিলেন, ‘এবার বাড়িতে যাব না। বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াতে সংকোচ হচ্ছে। তার চাইতে একা ঢাকাতেই ঈদ করব।’ ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছিল।
নানা কাজে আমাকে পরপর কয়েক দিন ব্যাংকে যেতে হয়েছে। পরদিন আবার গিয়েছি ব্যাংকে। গিয়ে দেখি, এই দুই ভদ্রলোক একজন আরেকজনের গলায় হাত রেখে পান খেতে খেতে বাইরে থেকে অফিসে ঢুকছেন! দেখে তো আমার চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! গতকালই না রীতিমতো ঝগড়া করছিলেন। খুব নিচু গলায় সামনে বসে থাকা নারী কর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘উনারা না কালই ঝগড়া করলেন!’ এই নারী কর্মী আমার দিকে তাকিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বলেছেন, ‘আরে, এটা তো উনাদের মহব্বতের ঝগড়া! ঝগড়া করেন। কিছুক্ষণ বাদেই আবার গলায়-গলায় ভাব!’
জগতের অনেক দেশে লেখাপড়া এবং চাকরির সুবাদে আমি থেকেছি। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু ঘুরে বেড়িয়েছি। আমার মনে হয় না এমন দৃশ্য অন্য কোনো দেশে খুব একটা দেখা যাবে। যাঁদের গতকালই রীতিমতো মারামারি করার মতো অবস্থা, তাঁদেরই আবার পরের দিন গলায়-গলায় ভাব!
আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আছে সম্পদের অপ্রতুলতা। এরপরও মানুষে মানুষে সম্পর্ক আর একে অপরের প্রতি ভালোবাসার অভাব নেই এই জনপদে। এই যে ঈদের সময় হাজার রকম হয়রানির পরও আমরা ঠিকই সবাই যে যাঁর বাড়িতে উপস্থিত হই। এটি তো একটি অনন্য উদাহরণ। যে মানুষটা দিন আনেন দিন খান, তিনিও অপেক্ষায় থাকেন ঈদের সময় হাতে কিছু নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হয়ে মা-বাবা, ভাই-বোনদের সঙ্গে একসঙ্গে ঈদ করবেন। কিন্তু সবাই কি পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারেন?
গতকালই পাশের বাসায় থাকে এক তরুণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। পাস করে বছর তিনেক বসে আছেন ঢাকায় চাকরি পাওয়ার আশায়। এখনো তেমন কোনো চাকরি জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলছিলেন, ‘এবার বাড়িতে যাব না। বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়াতে সংকোচ হচ্ছে। তার চাইতে একা ঢাকাতেই ঈদ করব।’ ছেলেটার জন্য মায়া হচ্ছিল। ঈদের সময় ফাঁকা হয়ে যাওয়া ঢাকা শহরে তাঁর ঈদ হয়তো একাকী কেটে যাবে।
আবার এমন অনেকেই আছেন, যাঁদের হয়তো চাকরি আছে। সামর্থ্য আছে। সবকিছুই আছে। কিন্তু একসঙ্গে ঈদ উদ্যাপন করার জন্য কেউ নেই। এই মানুষগুলোরও হয়তো ইচ্ছা হয় আশপাশে কারও সঙ্গে গল্প করতে, হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠেন উদ্যাপন করতে। সেটি হয়তো আর হয়ে ওঠে না।
আমার মনে হয়, সময় এসেছে ঈদের সময় এই মানুষগুলোর কথা ভাবার। দেশে এখন অনেক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রয়েছে। এসব সংস্থার উচিত এই মানুষগুলোর কথাও ভাবা। ঈদের সময় তাঁদের যেন মনে না হয়, আমাদের তো কেউ নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তাঁদের যেন একাকী মনে না হয়।
আমাদের দেশটা অনেক সুন্দর। বিশেষ করে পারিবারিক মূল্যবোধ, সম্পর্ক এবং যেকোনো উৎসব উদ্যাপনের ক্ষেত্রে আমরা সত্যিই নিজেদের একটা আলাদা ঐতিহ্য ধরে রেখেছি। এর মধ্যেও কিছু মানুষ রয়ে গেছেন। যাঁদের হয়তো কাজের চাপে, পারিবারিক কিংবা সামাজিক বাস্তবতায় সেভাবে উৎসব পালন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আমরা যেন তাঁদের ভুলে না যাই।
ড. আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি। ই-মেইল: [email protected]