দ্বিচারিতা আর আত্মসচেতনতার ঘাটতির আরেকটি সাক্ষ্যপ্রমাণ তৈরি হলো। ইসরায়েলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সব প্রেসিডেন্ট এক চিঠিতে বলেছেন, তাঁরা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে সহিংসতা, ইহুদিবিদ্বেষ (অ্যান্টি-সেমিটিজম) ও ইসরায়েলবিদ্বেষের প্রকাশ দেখে বিক্ষুব্ধ ও যন্ত্রণাগ্রস্ত। তাঁরা এখন ইহুদি ও ইসরায়েলিদের এখানকার মানে ইসরায়েলের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সহায়তা দেবেন বলেও জানিয়েছেন।
অন্যভাবে বললে, তাঁরা আসলে বলতে চাইছেন, ‘চলে এসো এরিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে! চুরি করে নেওয়া এই জায়গায়, বর্ণবাদী এলাকার প্রাণকেন্দ্রে, তোমরা পড়বে রাষ্ট্রনীতি, মানবাধিকার ও মানবমুক্তি নিয়ে। অন্য সব ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এরিয়েল বিশ্ববিদ্যালয়েও তোমরা দেখতে পারবে কাকে বলে সাম্য ও স্বাধীনতা। এখানে তোমরা আমেরিকার নির্যাতিত ইহুদিদের জন্য আশ্রয় খুঁজে পাবে। এরিয়েল তো ইহুদিদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান।’ [ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে জোরপূর্বক স্থাপিত ইহুদি বসতির মধ্যে এরিয়েল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৮২ সালে।]
প্রেসিডেন্ট মহোদয়গণ, যারা কাচের ঘরে বসবাস করে, তাদের কিন্তু ওখান থেকে ঢিল ছোড়া উচিত নয়। চিঠিতে যদি বুঝিয়ে থাকেন যে আপনারা যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি ছাত্র-শিক্ষকদের আশ্রয় দিতে চান, তাহলে মনে রাখবেন যে আপনাদের দেওয়ার মতো সামান্য কিছুই আছে।
হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার তুলনায় কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ক্যাম্পাস ইহুদি ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য অনেক নিরাপদ। কলাম্বিয়ার ইহুদি ছাত্রছাত্রীরা যতটা অস্বাচ্ছন্দ্যে আছে, তার চেয়ে আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতি আরব ছাত্র অনেক বেশি অস্বাচ্ছন্দ্যে আছে। এমনকি কলাম্বিয়ায় যে সম্ভাব্য বিপদের কথা বলা হচ্ছে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।
নোয়া ওরবাচ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী। হারেৎজ–এর হিব্রু সংস্করণে ২৬ এপ্রিল তিনি লিখেছেন, ‘একজন ইহুদি ও ইসরায়েলি ছাত্র হিসেবে আমি আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় কোনো রকম ভীতি বা হুমকি অনুভব করছি না।’
কিন্তু ইহুদিদের জন্য ওত পেতে থাকা দুনিয়াজোড়া বিভিন্ন বিপদকে ইসরায়েল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাতে পছন্দ করে এবং সেগুলোর মধ্যে নিমজ্জিত থাকতে চায়। এর ফলে বিভিন্ন দেশ থেকে ইসরায়েলে ইহুদিদের অভিবাসন দেখা দেয়, যা আলিইয়াহ নামে পরিচিত। আর এটা ইহুদিদের নিরাপদ আবাস হিসেবে ইসরায়েলের গল্পকথার জন্য বেশ ভালোই হয়! এমন নয় যে দুনিয়াজুড়ে কোথাও ইহুদিবিদ্বেষ নেই। কিন্তু সবকিছুই যদি ইহুদিবিদ্বেষ হয়, তাহলে তো ইসরায়েলের আর কোনো সমস্যাই থাকে না।
এটা সত্যি যে ইসরায়েলবিরোধী প্রতিবাদ এখানে–সেখানে ছড়িয়ে পড়ছে, যার মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ ও সহিংসতা আছে। কিন্তু যখন একটি নিস্পৃহ, তুষ্ট, ঘুমন্ত ক্যাম্পাস আর একটি টালমাটাল, দরদি, সহজাত ক্যাম্পাসের মধ্যে বেছে নিতে বলা হবে, তখন দ্বিতীয়টাই তো অধিক সম্ভাবনাময় বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিবেচিত হবে।
প্রেসিডেন্ট মহোদয়গণ, একটু বিনয় দেখালে তা আপনাদের জন্য কোনো ক্ষতির কারণও হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাসগুলোয় যা ঘটছে, তার জন্য আপনাদের ছাত্র-শিক্ষকেরা বরং ঈর্ষান্বিতই হতে পারে। রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে সচেতনতা ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস তো এমনই হওয়া প্রয়োজন।
একটি প্রাণবন্ত, সক্রিয়, বিদ্রোহী ক্যাম্পাসই তো এমন হবে, যা ইসরায়েলের বিষণ্ন ও নিষ্প্রভ ক্যাম্পাসগুলোয় কথিত আদর্শবাদী গোরস্থানের বিপরীত।
এটা সত্যি যে ইসরায়েলবিরোধী প্রতিবাদ এখানে–সেখানে ছড়িয়ে পড়ছে, যার মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ ও সহিংসতা আছে। কিন্তু যখন একটি নিস্পৃহ, তুষ্ট, ঘুমন্ত ক্যাম্পাস আর একটি টালমাটাল, দরদি, সহজাত ক্যাম্পাসের মধ্যে বেছে নিতে বলা হবে, তখন দ্বিতীয়টাই তো অধিক সম্ভাবনাময় বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বিবেচিত হবে।
পাঠক, আপনারা অবশ্য এখানে [ইসরায়েলে] যুক্তরাষ্ট্রের মতো সংগ্রামী ছাত্র-শিক্ষকের স্বপ্নই দেখতে পারেন। আর তারাই পারেন আগামীর প্রজন্মকে আশ্বস্ত করতে। ইসরায়েলের ক্যাম্পাসগুলোর বিরান ভূমিতে কোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক সম্ভাবনা বা প্রতিশ্রুতি বেড়ে উঠবে না।
আমেরিকার ছাত্রছাত্রীদের প্রতিবাদ যদি লাগামছাড়া ও বিভ্রান্তিকর হয়েও ওঠে, তবু তারা কিন্তু সক্রিয় অংশগ্রহণ ও চিন্তাশীলতা দেখিয়ে যাচ্ছে। দূরে আরেক মহাদেশে যুদ্ধ দেখা দিলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল বের করার কোনো সম্ভাবনাই কোনো একটি ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।
অবশ্য কোনো এক শুভদিনে এখানকার কোনো ক্যাম্পাস হয়তো এমন কোনো প্রতিবাদে ফেটে পড়বে। তবে তা হবে লেখাপড়ার খরচের কিংবা সেনাবাহিনীতে সংরক্ষিত সৈনিক হিসেবে যুক্ত হওয়ার শর্তের বিনিময়ে। আরেকটু ভালো দিন যদি হয়, তখন হয়তো হাতে গোনা কয়েকজন ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান ফটকের সামনে নীরবে দাঁড়াবে ফিলিস্তিনের নাকবা স্মরণে আর তাদের ঘিরে রাখবে কয়েক ডজন সশস্ত্র পুলিশ।
ইসরায়েলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধানেরা তাঁদের প্রতিষ্ঠানে ‘ডাইনি খোঁজার’ কাজকে গোপন করে রাখছেন, যা ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কেবল জোরদারই হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর কয়েক দিনের মধ্যে হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ ঘোষণা দিয়ে বসে যে যারা ফিলিস্তিনিদের সমর্থন দেওয়ার দুঃসাহস দেখাবে, তাদের ছাত্রত্ব স্থগিত করতে সংসদ সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
ঘোষণায় এ–ও লেখা হলো, ‘এই সময়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে গেছে।’ এভাবেই বিদ্যায়তনগুলোয় ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর রাজনৈতিক নির্যাতন শুরু হলো। এর শিকার হলেন প্রফেসর নাদেরা শালহুব-কেভোরকিয়ান, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। তাঁর শিক্ষকতার কাজ স্থগিত করা হলো এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো।
আবার একজন ইসরায়েলি সামাজিক গণমাধ্যমে কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করায় চাকরিচ্যুত হলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রেসিডেন্টরা এ ঘটনাগুলোয় তেমন বিচলিত নন, যতটা বিচলিত-বিক্ষুব্ধ আমেরিকায় যা হচ্ছে তা নিয়ে।
তবে আমেরিকায় সংগঠিত প্রতিবাদ নিয়ে ইসরায়েলের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। এর একাংশ তো ইতিমধ্যেই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঘৃণায় রূপ নিয়েছে এবং মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার ডাক দিচ্ছে। তবে, আমাদের অবশ্যই বরাবরের মতো ঘটনার মূলে যেতে হবে।
আমেরিকার ছাত্রছাত্রীরা গাজার বীভৎস যুদ্ধের ভয়াবহতা অনেক বেশি মাত্রায় অবলোকন করেছে, যা তাদের আত্মতৃপ্ত ইসরায়েলি সহপাঠীরা করেনি। এটা যদি যুদ্ধ না হতো, না হতো দখলদারি এবং বর্ণবাদ, তাহলে এই প্রতিবাদের ঝড় উঠত না।
গিডিয়ন লেভি একজন ইসরায়েলি সাংবাদিক। ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ–এ প্রকাশিত তাঁর লেখাটির ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া