বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভোট এখন আর উৎসব নয়, রীতিমতো আতঙ্ক। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনেই রেকর্ডসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি দেখা যায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ভোট পড়ে ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে (১২ জুন) ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০০১ সালে ৭৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ২০০৮ সালে ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এরপরই বাংলাদেশে ভোটে খরা শুরু হয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভোট পড়েছে মাত্র ৩৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ১৫৪টি আসনে প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন বিনা ভোটে। এখন ভোট মানে ভোটকেন্দ্রে প্রার্থীদের লড়াই নয়। ভোটকেন্দ্রের বাইরে রাজনৈতিক নেতৃত্বের লড়াই।
আমাদের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন, অনির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা একমুহূর্তও দেশ পরিচালিত হতে পারবে না। সেই রায়ে নিশ্চয়ই নিয়ম রক্ষার কিংবা একতরফা ভোটের কথা বলা হয়নি। নির্বাচন মানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটারের প্রার্থী বাছাই করার অবারিত সুযোগ। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের চেহারা কী হয়, সেটা আমরা অতীতে অনেকবার দেখেছি।
এবার পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখছি। কোথাও নির্বাচনের উত্তাপ নেই। যেটুকু উত্তেজনা আছে, ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ও বিদ্রোহী প্রার্থী কিংবা বিপক্ষ দলের মধ্যে। নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি না থাকায় আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগই।
যেখানে বাংলাদেশে একটি বড় শহরে নির্বাচন হলে তার উত্তাপ মোটামুটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত, সেখানে পাঁচ সিটির নির্বাচনও জনগণকে আগ্রহী করতে পারছে না। পাঁচ সিটির নির্বাচন যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনের পূর্ব মহড়া হয়ে থাকে, তাহলে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। বিএনপি সিটি নির্বাচন বর্জন করেছে; ঠেকানোর কথা বলেনি। জাতীয় নির্বাচনে তারা কী কৌশল নেয়, সরকার তাদের মোকাবিলায় কী কী পদক্ষেপ নেয়, তার ওপরই রাজনীতির গতিবিধি নির্ধারিত হবে। কিন্তু নির্বাচনের মূল নিয়ামক যে জনগণ বা ভোটার, তঁারা উপেক্ষিতই থেকে যাবেন, যাচ্ছেন।
২.
সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সব সময়ই বলে থাকেন, নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। তারাই জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সব নির্বাচন পরিচালন করে থাকে। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘না’ ভোটের বিধান চালু করেছিল। অর্থাৎ ভোটাররা তাঁদের পছন্দসই প্রার্থীকে যেমন ভোট দিতে পারবেন, তেমনি কোনো প্রার্থীকে পছন্দ না হলে ‘না’ ভোটও দিতে পারবেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পছন্দসই প্রার্থী না পাওয়ায় সারা দেশে ‘না’ ভোট দিয়েছেন ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৬১৫ জন ভোটার। শতকরা হিসাবে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ। খোদ ঢাকার আসনগুলোতে ‘না’ ভোট পড়েছে ৭০ হাজার।
আমাদের সরকারগুলো নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ততটুকুই দিতে রাজি, যতটুকু দিলে তারা নিরাপদ বোধ করে। সেটা ‘না’ ভোটের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি ফলাফল বাতিলের ক্ষেত্রেও। নির্বাচনের ফলাফল গেজেটভুক্ত হওয়া কিংবা কয়েক বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরও উচ্চ আদালতের রায়ে সদস্যপদ বাতিল হওয়ার একাধিক নজির আছে। তাহলে পুরো আসনের ফলাফল বাতিল কিংবা গেজেট হওয়ার পর ফলাফল বাতিল করার ক্ষমতা ইসিকে দিতে আপত্তি কেন?
রাজনৈতিক দলগুলো অনেক সময় যোগ্য প্রার্থী না দিয়ে ‘কলাগাছ’ দাঁড় করিয়ে থাকে। ভোটাররা এই ‘কলাগাছকে’ ভোট দিতে বাধ্য নন। পৃথিবীর অনেক দেশেই ‘না’ ভোট চালু আছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সেই বিধান বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের কাজেই কেবল হস্তক্ষেপ করা হয়নি; ভোটারদের অধিকারও খর্ব করা হয়েছে।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল, নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগে কোনো ভোটকেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটের ফলাফল স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা যেন তাদের দেওয়া হয়।
সরকার সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়, যেসব ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, শুধু সেসব (এক বা একাধিক) কেন্দ্রের ভোট স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা থাকবে ইসির। ইসিকে পুরো আসনের ফলাফল বাতিলের ক্ষমতা না দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে মন্ত্রিসভা।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে এটি অনুমোদনের পর এখন তা জাতীয় সংসদে বিল আকারে তোলা হবে। জাতীয় সংসদে পাস হলে এটি আইনের অংশ হবে।
প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব করে গত বছর আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। গত ২৮ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে আরপিওর সংশোধনের বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।
জাতীয় নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১(এ) ধারায় বলা আছে, ‘নির্বাচন কমিশন যদি সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত ও আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) আমলে কাদের সিদ্দিকীর ছেড়ে দেওয়া আসনের উপনির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগে ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করতে রাজি হননি তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা। তিনি ছুটিতে যাওয়ার পরই ফলাফল গেজেটভুক্ত করা হয়।
গত বছরের অক্টোবরে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে বেশ কিছু ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা দেখে পুরো আসনের ভোটই বন্ধ করে দিয়েছিল ইসি। তখন ইসির এ সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন আওয়ামী লীগের অনেক নেতা। পরবর্তীকালে ইসি পুনর্নির্বাচনের নামে যা করেছে, সেটি অনেকটা ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’। তারা অভিযুক্ত কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বরং যাঁদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ ছিল, তাঁদের দিয়েই পুনর্নির্বাচন করানো হয়েছে।
৩.
আমাদের সরকারগুলো নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ততটুকুই দিতে রাজি, যতটুকু দিলে তারা নিরাপদ বোধ করে। সেটা ‘না’ ভোটের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি ফলাফল বাতিলের ক্ষেত্রেও। নির্বাচনের ফলাফল গেজেটভুক্ত হওয়া কিংবা কয়েক বছর সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরও উচ্চ আদালতের রায়ে সদস্যপদ বাতিল হওয়ার একাধিক নজির আছে। তাহলে পুরো আসনের ফলাফল বাতিল কিংবা গেজেট হওয়ার পর ফলাফল বাতিল করার ক্ষমতা ইসিকে দিতে আপত্তি কেন?
অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রের জন্য আরপিওর যেসব শর্ত ছিল (নারী নেতৃত্বসহ) সেগুলো পূরণের সময়সীমা ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ২০০৮ সালে যখন আরপিও সংশোধন করা হয়, তখন সব দলই ২০২১ সালের মধ্যে নারী নেতৃত্ব এক-তৃতীয়াংশ করার অঙ্গীকার করেছিল। নেতাদের হাবভাবে মনে হয়েছিল, নির্ধারিত সময়ের আগেই তাঁরা এটা করে ফেলবেন। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো নারীর ভূমিকা অনুল্লেখ্য, অন্তত সংখ্যার বিচারে।
উল্লেখ্য, ৩২ বছর ধরেই সরকারপ্রধান ও সংসদে বিরোধী দলের নেতার পদ অলংকৃত করে আছেন নারী। দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বেও তাঁরা। তারপরও সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটে নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে তাঁরা সাহস পান না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি