বুদ্ধের শিক্ষায় অশান্ত বিশ্বে শান্তি নামুক

রাজা শুদ্ধোধন ও রানি মহামায়া দম্পতির দীর্ঘ সাংসারিক জীবনে প্রথম দিকে কোনো সন্তান তখনো জন্মগ্রহণ করেনি। অবশেষে দীর্ঘ সময় পর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তাঁদের কোল আলোকিত করে জন্ম নিল এক পারমীপূর্ণ সত্ত্ব। এদিকে দীর্ঘ সময় পর মনের ইচ্ছা সিদ্ধি লাভ করায় পিতা রাজা শুদ্ধোধন নবজাতকের নাম রাখলেন সিদ্ধার্থ।

বুদ্ধত্ব লাভের জন্য সত্ত্বগণকে কোটি কোটি কল্প ধরে বোধিসত্ত্ব রূপে নানা যোনিতে জন্মগ্রহণ করে পারমী পূর্ণ করতে হয়। অবশেষে পারমী পরিপূর্ণ হলে বোধিসত্ত্ব অভিসম্বুদ্ধ হন। সম্যক সম্বুদ্ধত্ব লাভের পর ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন এবং একসময় মহাপরিনির্বাণ সাক্ষাৎ করেন।

জগতে নির্দিষ্ট কালের জন্য প্রবর্তিত এই ধর্ম প্রচলিত থাকে; পরে এর বিলোপ হয়। তখন নষ্টসত্যের পুনরুদ্ধার করে জগতের পরিত্রাণহেতু নতুন কোনো বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। বর্তমান মহাভদ্র কল্পের চতুর্থ সম্যক সম্বুদ্ধ গৌতম সম্যক সম্বুদ্ধ এই ধারাবাহিকতার অংশমাত্র।

একদিন শিশু সিদ্ধার্থ সারা দিন জম্বুবৃক্ষমূলে ধ্যানস্থ হয়ে বসেছিলেন। এদিকে তাঁর কষ্ট হবে বলে ওই বৃক্ষের ছায়া নিশ্চল হয়ে থেকে গিয়েছিল। কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত! পিতা শুদ্ধোধন ভালো করেই বুঝতে পারলেন, তাঁর নয়নের মণি সিদ্ধার্থ সাধারণ কোনো সত্ত্ব নন।

জন্মজন্মান্তরে ৩০ প্রকার পারমী পরিপূরণ করে মনুষ্যলোকের শেষ জন্ম রাজা বিশ্বন্তরের দানশীল ও পরম ত্যাগী জীবন সম্পন্ন করে তিনি তুষিত স্বর্গে আরোহণ করেন। তুষিত স্বর্গের পরমায়ু অনুযায়ী, সেখানে সন্তোষিত দেবপুত্র হয়ে ৫৭ কোটি ৬০ লাখ বছর অবস্থান করেন। মূলত সেখান থেকে চ্যুত হয়েই তিনি রাজা শুদ্ধোধন এবং রানি মহামায়ার সংসারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

তিনি সত্ত্ব হিসেবে বুদ্ধাঙ্কুর (বোধিসত্ত্ব)। সংসারের মায়াজালে আটকে থাকার জন্য তাঁর জন্ম হয়নি। এটা পিতা শুদ্ধোধনও শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলেন ঋষি অসিত দেবলের মাথার ওপরে নবজাতক শিশু সিদ্ধার্থের পা রাখার ঘটনায়।

সিদ্ধার্থের জন্মের ঘটনায় দেবলোকেও আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধাঙ্কুর সিদ্ধার্থের জন্মের কথা জেনে স্বর্গ থেকে ঋষি অসিত দেবল সিদ্ধার্থকে পুণ্যদর্শন করতে এসেছিলেন। ঋষি অসিত দেবলের মাথার ওপরে নবজাতক শিশু সিদ্ধার্থের পা রাখার ঘটনাটি তখন ঘটে যায়। এই দৃশ্য দেখে পিতা শুদ্ধোধন চরমভাবে ঘাবড়ে যান। পরে ঋষি অসিত দেবল স্বয়ং জানালেন মহারাজ আপনার এই সন্তান সাধারণ কেউ নন; তিনি এই জগৎসংসারের ভাবী সম্যক সম্বুদ্ধ।

রাজা শুদ্ধোধন দ্বিতীয়বার আরও একটি ঘটনার সাক্ষী হলেন। একদিন শিশু সিদ্ধার্থ সারা দিন জম্বুবৃক্ষমূলে ধ্যানস্থ হয়ে বসেছিলেন। এদিকে তাঁর কষ্ট হবে বলে ওই বৃক্ষের ছায়া নিশ্চল হয়ে থেকে গিয়েছিল। কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত! পিতা শুদ্ধোধন ভালো করেই বুঝতে পারলেন, তাঁর নয়নের মণি সিদ্ধার্থ সাধারণ কোনো সত্ত্ব নন।

সিদ্ধার্থকে সংসারে ধরে রাখতে একজন পিতা হিসেবে এবং একজন রাজা হিসেবে যা যা করার থাকে, তার চেয়েও বেশি চেষ্টা করেছেন। তবু রাজকুমার সিদ্ধার্থকে সংসারে ধরে রাখা যায়নি। চারি নিমিত্ত দর্শন করে ২৯ বছর বয়সে তিনি সংসার পরিত্যাগ করলেন।

ছয় বছর কঠোর সাধনা বলে ৩৫ বছর বয়সে অবশেষে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি গয়ার বোধিদ্রুমমূলে বসে সর্বজ্ঞতা তথা বুদ্ধত্ব লাভ করলেন।

বুদ্ধত্ব লাভের পর বুদ্ধ সাত সপ্তাহ গয়ার বোধিদ্রুমকে কেন্দ্র করে অতিবাহিত করেন। অবিস্মরণীয় নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সেখানে বুদ্ধের সাত সপ্তাহ কাটে। এরপর বুদ্ধ নবলব্ধ জ্ঞান প্রচারের জন্য সারনাথের উদ্দেশে ধর্মযাত্রা শুরু করলেন।

শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে বসে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের উপলক্ষ করে জগতে প্রথম ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন। বুদ্ধ কর্তৃক মধ্যম পন্থার মাহাত্ম্য বর্ণনা, চারি আর্যসত্যের বিস্তর বর্ণনা, আর্যঅষ্টাঙ্গিক মার্গসংবলিত সদ্ধর্ম দেশনা শ্রবণ করে পর্যায়ক্রমে তাঁরা সকলে অর্হৎ মার্গ ফলে প্রতিষ্ঠিত হন।

জগতে বুদ্ধের পরে ওই পঞ্চবর্গীয় শিষ্যরাই হলেন প্রথম অর্হৎ ভিক্ষুসংঘ। পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের কেন্দ্র করে শুরু হওয়া বুদ্ধের এই ধর্ম অভিযান চলে দীর্ঘ ৪৫ বছর পর্যন্ত। একদিকে চারি পরিষদ গঠন এবং তাদের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার কর্মযজ্ঞ, অপর দিকে ধর্ম প্রচার অভিযানের মাধ্যমে সত্ত্বগণকে দুঃখমুক্তির পথ দেখানোর ব্রত বুদ্ধ সমানেই করে গেছেন।

অবশেষে ৮০ বছর বয়সে হিরণ্যবতী নদীর অপর পাড়ে কুশিনগরের উপবর্ত্তনস্থ জোড়া শালবৃক্ষের নিচে নির্বাণশয্যায় শায়িত হলেন। সেদিনও ছিল শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। বুদ্ধ নামের যে মহাসূর্য শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে উদিত হয়েছিলেন; জগৎকে মুক্ত জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে পুনরায় শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে অস্তমিত হলেন।

রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম, বোধিলাভ এবং তথাগত বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ সাক্ষাৎ এই তিন কালজয়ী ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়। তাই বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম বুদ্ধপূর্ণিমা। এই আনন্দক্ষণে অশান্ত বিশ্বের শান্তি বর্ষিত হোক।

● প্রজ্ঞানন্দ থের রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার