আমার এই বছর শুরু হয়েছে শ্রীলঙ্কায়। দেশটির ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে একটি সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের আমন্ত্রণ বহুদিনের আগ্রহের দেশটিকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ এনে দেয়। আমি যখন সে দেশে যাই, তার আগে থেকে এটি বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের বড় খবর। আর্থিক সংকটে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার পথে। তেল কেনার পয়সা নেই, জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। বিক্ষুব্ধ মানুষেরা টেনে নামিয়েছে দেশটির পরিবারকেন্দ্রিক ক্ষমতাসীনদের। সবার তাই প্রশ্ন, কীভাবে এই দেশে তারা সম্মেলন করে?
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি কলম্বোর উল্টো প্রান্ত বাত্তিকালোতে যেতে প্রায় সাত ঘণ্টা লাগে। এই যাত্রাপথে প্রচুর বড় গাছ, বনজঙ্গল, বেশ কয়টি গভীর জঙ্গল পার হতে হয়। সেখানে একটু পরপর বন্য হাতি, হরিণের সমাবেশ দেখা যায়। হাতির ভাব দেখে মনে হয়, তারা গভীর জঙ্গল থেকে রাস্তার ধারে এসেছে ‘চিড়িয়াখানার’ মানুষ দেখতে।
পরেও শ্রীলঙ্কার কয়েকটি শহর, গ্রাম ও ক্যাম্পাসে গিয়ে কয়েকটা বিষয় দেখে খুব স্বস্তি এবং সুস্থ বোধ করেছি, আমাদের এখানে যেগুলোর খুব অভাব। এর একটি হলো সজীব প্রাণপ্রকৃতি, নারকেল-তাল-বটসহ দেশি বড় বড় গাছে ভরা চারপাশ। স্বচ্ছ পানি, নরম বাতাস, শ্বাস নিতেও আরাম। ক্যাম্পাস খুবই পরিচ্ছন্ন, ভেতরে বেশ কয়েকটি বটগাছ ছাড়াও সব দেশি বড় বড় গাছ, গাছে পাখির সমাবেশ।
দ্বিতীয়ত, দিনে–রাতে শহরে-গ্রামে মেয়েদের নিঃসংকোচ চলাফেরা—হাঁটা, সাইকেল ও মোটরসাইকেলে।
তৃতীয়ত, রাস্তাঘাট, ভবন, সর্বত্র আবর্জনামুক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। সম্ভবত বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাবে শ্রীলঙ্কায় প্রতি মাসে পূর্ণিমায় জাতীয় ছুটি থাকে। এ রকম একটি দারুণ খবর আগে জানা ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় পরিচয়ে প্রধান চারটি ভাগ—সিংহলি বৌদ্ধ, তামিল হিন্দু ও তামিল মুসলিম এবং খ্রিষ্টান। সিংহলিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, পুরো শ্রীলঙ্কাতেই তাই। সারা দেশে ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ, ১৩ শতাংশ হিন্দু, ১০ শতাংশ মুসলিম ও ৬ শতাংশ খ্রিষ্টান। বাত্তিকালো এলাকায় মুসলিম জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর অনুপাত বেশি, হিজাব পরা কয়জন ছাত্রীর সঙ্গেও কথা হলো। সংখ্যা যা-ই থাক, ক্যাম্পাসে সবার ধর্মীয় কেন্দ্র রাখা হয়েছে একই রকম গুরুত্ব দিয়ে।
শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়ার খবর নিয়ে বিশ্বজুড়ে এবং বাংলাদেশে যত খবর প্রচার হয়েছে, তার একাংশও এই দেশটির অর্জন নিয়ে হয়নি। যেমন আমরা যখন বলি বিনা বেতনে অভিন্ন শিক্ষা সব নাগরিকের অধিকারের বিষয়, তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, তখন এ দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষ, সরকার তো বটেই, বিদ্বজ্জন, এমনকি যাঁদের এই অধিকার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাঁদের কাছেও এটি খুব বাস্তবায়নযোগ্য মনে হয় না।
বারবার প্রশ্ন আসছিল, সংকট সমাধানে আইএমএফের ঋণ অপরিহার্য কি না। আগে আরও ১৬ বার আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা, তাই তাদের নীতিমালা বাস্তবায়ন চলছিল আগে থেকেই, সংকট বরং জটিল হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি আইএমএফ ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান, ২২ বার। তাদের সংকট সবচেয়ে বেশি। জন হপকিন্স ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকসের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে আইএমএফ ঋণ নেওয়া অর্থনীতিগুলোতে বেকারত্ব আরও বেড়েছে।
মাথায় চাপিয়ে দেওয়া কিছু যুক্তি শোনা যায়—‘কীভাবে এটা সম্ভব?’ ‘এত টাকা কোথায়?’
কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে অনেক ছোট অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা দেশের সব নাগরিকের জন্য কয়েক দশক আগেই প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিনা মূল্যে শিক্ষা ও সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নিশ্চিত করেছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলঙ্কা আসলে বহু দিক থেকেই এগিয়ে ছিল। দীর্ঘকাল জাতিগত-ধর্মীয় যুদ্ধ-সংঘাত সত্ত্বেও মানব উন্নয়ন সূচকে শ্রীলঙ্কা অনেক ওপরে থেকেছে বহু বছর ধরেই (উচ্চ-০.৭৮২)। দারিদ্র্যের হার, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হার, শিক্ষার হার, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যসেবা—সবকিছুতেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের চেয়ে শ্রীলঙ্কা অনেক ভালো অবস্থায় বরাবরই, বৈষম্যের হারও কম।
কোভিড ব্যবস্থাপনায় শ্রীলঙ্কা অনেক গোছানো ছিল। ফলে এখানে আক্রান্ত ও মৃত্যু তুলনামূলক অনেক কম। মাথাপিছু জিডিপিতেও এই দেশগুলোর তুলনায় শ্রীলঙ্কা উচ্চতর অবস্থানে, এত সংকটের পরও প্রায় ৪ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলার।
অথচ জমে ওঠা অর্থনৈতিক সংকটে এই দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের জীবনই বিপর্যস্ত হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে দ্বিগুণ থেকে চার গুণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় আগের আয়ের অর্ধেকের নিচে চলে গেছে। অপুষ্টি–অনাহার বেড়েছে। তবে যারা এই সংকটের কারণ, সেই ক্ষুদ্র অংশ এই সময়ে আরও ধনী হয়েছে। সচ্ছল উদ্বৃত্ত বা ধনী অংশ এবং যাঁদের প্রবাসী আয় থেকে টাকা আসে, তাঁরা ছাড়া বাকি সবাইকে ভয়াবহ চাপের মধ্যে পড়তে হয়েছে। বেকারত্ব বেড়েছে, নিয়মিত বহু কাজ আউটসোর্সিংয়ে চলে গেছে।
সম্মেলনে উন্নয়ন আর পরিবেশ প্রশ্ন নিয়ে দুই দিন ধরে অনেক অধিবেশনে বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে এসব বিষয় নিয়েও আলোচনা হলো। সম্মেলন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অর্থনীতি বিভাগের সব শিক্ষককে ডেকে আমার সঙ্গে বসলেন। শ্রীলঙ্কার সংকট ও আইএমএফ নিয়ে আমার বক্তব্য শোনার জন্য এই সভা। ওই দেশের সংকটের কারণ আমার থেকে তাঁদেরই ভালো জানার কথা।
তবে দেশে প্রায় অভিন্ন অভিজ্ঞতার কারণে বললাম যে অপরিণামদর্শী নীতি, বাণিজ্যিক ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি, বিচার-বিবেচনাহীন মেগা প্রজেক্ট, পুঁজিপন্থী সংস্কার, এক পরিবারের কর্তৃত্বে ব্যাপক দুর্নীতির বিস্তার আর সেই সঙ্গে প্রতিকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে সংকটাপন্ন করেছে। বিদেশি ঋণের মেগা প্রকল্পগুলো যে যথাযথভাবে বাছাই হয়নি, খরচ অনেক বেশি, প্রতি পদে অনিয়ম, তা দেশের অডিটর জেনারেলের প্রতিবেদনেও প্রকাশিত হয়েছে।
২০০৫ থেকে শ্রীলঙ্কায় বিদেশি ঋণ ক্রমেই বেড়েছে, সে বছর ছিল ১১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২০ সালের মধ্যে তা ৬০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়, যা তাদের বার্ষিক জাতীয় আয়ের চেয়ে বেশি। ব্যয়বহুল মেগা প্রকল্পের খরচ মেটাতে ২০০৭ সালে শ্রীলঙ্কা প্রথম উচ্চ সুদে সভরেন বন্ড চালু করে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার থেকেই ঋণ সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশ। এরপর বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থা থেকে ২২ শতাংশ, জাপান ও চীন থেকে ১০ শতাংশ করে।
২০২২ থেকে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের চাপ মারাত্মক আকার নেয়। রুপির মান কমতে থাকায় প্রবাসী অর্থ অফিশিয়াল পথে আসা অর্ধেকের বেশি কমে যায়। এর মধ্যেও বিশ্বব্যাংক ২০২১ সালে জানায়, কিছু সমস্যা থাকলেও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে! আইএমএফের ভবিষ্যদ্বাণীও একই রকম। ২০২২ সালে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ৬০ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়।
বারবার প্রশ্ন আসছিল, সংকট সমাধানে আইএমএফের ঋণ অপরিহার্য কি না। আগে আরও ১৬ বার আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা, তাই তাদের নীতিমালা বাস্তবায়ন চলছিল আগে থেকেই, সংকট বরং জটিল হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি আইএমএফ ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান, ২২ বার। তাদের সংকট সবচেয়ে বেশি। জন হপকিন্স ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিকসের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে আইএমএফ ঋণ নেওয়া অর্থনীতিগুলোতে বেকারত্ব আরও বেড়েছে।
যারা ঋণ নেয়নি, তারা বরং বেকারত্ব হ্রাস ও অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনতে ভালো ফলাফল পেয়েছে। বিভিন্ন দেশের দৃষ্টান্ত টেনে যা বললাম, তার সারকথা হলো আইএমএফকে উদ্ধারকর্তা সংস্থা হিসেবে প্রচার করা হয়। কিন্তু এটি তাদেরই উদ্ধার করতে আসে, যাদের জন্য দেশ ও মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়।
মানুষের ওপর তারা আরও বোঝা চাপায় গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির দাম বাড়ানোর চাপ সৃষ্টি করে, আরও বাণিজ্যিকীকরণ করে। আইএমএফের শর্ত মেনে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে, করহার বাড়ানো হয়েছে, রপ্তানিমুখী নীতি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে, জনস্বার্থের ক্ষেত্রগুলোতে বাজেট কমানো হচ্ছে। সব দেশেই আইএমএফের ঋণ সরকারসহ ক্ষমতাবানদের জন্য স্বস্তি আর জনগণের জন্য চাপ বৃদ্ধি।
বাংলাদেশের সংকটের কারণ একই রকম, এখানেও আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক কারণ দূর করতে আগ্রহী নয়, কেননা তারাও এর সুবিধাভোগী। উচ্চ রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশে কম।
অন্যদিকে শিক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থার উচ্চ বাণিজ্যিকীকরণ, দুর্বল সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ও উন্নয়নের নামে প্রাণপ্রকৃতিবিনাশী উন্মাদনার কারণে বাংলাদেশের মানুষের জীবন তুলনামূলক অনেক বেশি কঠিন। বাংলাদেশের আরও বাড়তি ঘটনা জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি নির্বাচন ও জবাবদিহির ব্যবস্থায় সামগ্রিক ধস, যা শ্রীলঙ্কায় এখনো কিছু কাজ করছে।
আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক