২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পুতিনের নির্দয় যুদ্ধের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্বে অভূতপূর্ব ঐক্য কতটা অটুট থাকবে

যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করতে চলেছে। এ সময় ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা নাগরিকদের সংহতি খুবই মূল্যবান।ছবি : রয়টার্স

স্বেচ্ছাচারী শাসকের জন্য ঘটনাটি ছিল একটা সহজ ভুল। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন ইউক্রেনের ওপর নিষ্ঠুর আগ্রাসন শুরু করেছিলেন, সে সময় তিনি দেশটির বীর জনতা ও মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ে তাঁদের সংকল্পের দৃঢ়তা সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছিলেন। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সংহতি সম্পর্কেও পুতিন ভুল বুঝেছিলেন।

পুতিন কেন গণতান্ত্রিক বিশ্ব সম্পর্কে এমন ভুল ধারণা পোষণ করেছিলেন, সেটা আপনারা সে সময় নিজের চোখেই দেখতে পেয়েছিলেন। রাশিয়ার সেনাবাহিনী যখন প্রতিবেশী ইউক্রেনকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে সামরিক অভিযান শুরু করে, তখন প্রধানমন্ত্রীর কেলেঙ্কারিতে জেরবার ছিল যুক্তরাজ্য সরকার। চরম হতাশা থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছিলেন, ন্যাটোর ‘মস্তিষ্কমৃত্যু’ হয়ে গেছে। রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভয়ংকরভাবে নির্ভরশীল জার্মানিতে ওলাফ শলৎজ সবে চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিন জোটের একটি অপরীক্ষিত সরকার গঠন করেছেন। আফগানিস্তান থেকে অপমানজনকভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের পর যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন সরকারের ওপর জনগণের আস্থা নড়বড়ে অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল। শুধু পুতিন একা নন, মুক্ত বিশ্বে এমন মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছিল, যাঁরা ভাবতে পছন্দ করেন, গণতন্ত্র এতটা দুর্বল, ক্ষয়িষ্ণু ও বিভক্ত হয়ে গেছে যে, সেটা আর নিজের মূল্যবোধ রক্ষা করতে সক্ষম নয়। সে কারণে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরক্ষার সক্ষমতা এবং দেশটিকে দেওয়া পশ্চিমাদের সমর্থন সম্পর্কে শুধু ক্রেমলিনের স্বৈরশাসক নন, আরও অনেকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছিলেন।

কিন্তু ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সেই ভঙ্গুর ও অগোছালো গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো আশাব্যঞ্জক ঐক্য ও সংকল্প নিয়ে একসঙ্গে চলতে শুরু করে। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক শিবিরের এই ঐক্য ১২ মাস পরও একই রকম টেকসই রয়েছে। নিজেদের ভোটার কমে যাবে, সেই আশঙ্কা দেখা দেওয়ার পরও দেশগুলোর সরকার রাশিয়ার ওপর এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। সামরিক ও মানবিক সহায়তা হিসেবে ইউক্রেনকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে। পুনর্জীবন পাওয়া ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার জন্য ফিনল্যান্ড ও সুইডেন আবেদনপত্র জমা দিয়েছে।

পশ্চিমাদের এ প্রতিক্রিয়ার একদিকে আছে ইউক্রেনের জনগণের প্রতি সমবেদনা; অন্যদিকে, পুতিন জিতলে তারপর কী হবে, সেই ভীতি। যদিও ইউক্রেনে কী পরিমাণ এবং কত ভারী অস্ত্র দেওয়া হবে, তা নিয়ে জোটগুলোর ভেতরে ও মধ্যে নানা উত্তেজনা ও চাপান-উতোর চলেছে। সাম্প্রতিক তর্ক-বিতর্কটা চলছে যুদ্ধবিমান নিয়ে। এর আগে বিতর্কটা হয়েছিল অত্যাধুনিক মেইন ব্যাটল ট্যাংকস নিয়ে। গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের তর্ক-বিতর্ক খুব স্বাভাবিক। সেটা খুব বড় বাধাও নয়। যতটা ধারণা করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য পদক্ষেপ নিয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলো পুতিনকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে।

আরও পড়ুন

যুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে বিভক্তি থাকার পরও এই সংঘাতে তাঁদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ও ধারাবাহিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। গত সপ্তাহে ভলোদিমির জেলেনস্কি ব্রিটেন সফরে আসেন। তাঁর এ সফর ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাজ্যের দেওয়া সমর্থনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। যুক্তরাষ্ট্রের পর যুক্তরাজ্য ইউক্রেনে দ্বিতীয় বৃহৎ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহকারী দেশ। নিজ দেশেই যখন বড় ধরনের আর্থিক সংকট চলছে, সে সময় বিপুল জনসমর্থন পেয়ে এবং লেবার দলীয় আইনপ্রণেতাদের বিরোধিতা ছাড়াই ইউক্রেনকে এ সহযোগিতা করেছে যুক্তরাজ্য।

সম্প্রতি ২৮টি গণতান্ত্রিক দেশে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যে জরিপ চালানো হয়েছে, তার ফলাফলে উদ্বিগ্ন হওয়ারও কারণ আছে। কেননা, ৪২ শতাংশ মতামত প্রদানকারী এই মতের সঙ্গের ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে ‘ইউক্রেনের সমস্যা আমাদের বিষয় নয় এবং এ বিষয়ে আমাদের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।’

সংঘাত চলাকালে, পশ্চিমা দেশগুলোর রাজধানীগুলোয় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। নাগরিকদের মধ্যে ‘যুদ্ধের বিবমিষা’ সৃষ্টি হওয়ায় ক্রেমলিন আশা করেছিল, ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন কমে আসবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশে জনসমর্থন এখনো সৃদৃঢ় রয়েছে। এর কারণ হলো, ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনী যে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে চলেছে, তার প্রতি তাদের প্রবল আপত্তি।

আরেকটি বিষয় হলো, রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইউরোপের নির্ভরতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন পুতিন। কিন্তু এবারে প্রকৃতিও পশ্চিমাদের পক্ষে। স্বাভাবিকের চেয়ে উষ্ণতর শীতকালের কারণে এবারে পশ্চিমা সরকারগুলোকে তাদের নাগরিকদের জ্বালানি খাতে বড় ধরনের ভর্তুকি দিতে হয়নি। সাম্প্রতিক জরিপ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেনে অস্ত্রসরবরাহ সমর্থন করেন। অর্ধেকের বেশি পশ্চিমা নাগরিক বলছেন যে একটি সার্বভৌম দেশকে আক্রমণকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে জ্বালানির যে উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে, সেটা আসলে খুব বড় কোনো ত্যাগ নয়।

জেনারেল মার্ক মিলি সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, ‘ইউক্রেনে অধিকৃত ভূমি থেকে রাশিয়ানদের এ বছরের মধ্যে পুরোপুরি হটিয়ে দেওয়া খুব, খুব কঠিন একটি কাজ।’
ছবি : রয়টার্স

যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করতে চলেছে। এ সময় ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমা নাগরিকদের সংহতি খুবই মূল্যবান। ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের ছয়টি অঞ্চলকে এখন পর্যন্ত রাশিয়া নিজেদের দখলে রেখেছে। উপদ্বীপটি ২০১৪ সালে অধিকারে নেয় রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধের যে গতিপ্রকৃতি, তাতে করে এ পর্যন্ত করা অনুমান খুব কম ক্ষেত্রেই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে একমাত্র অতি আশাবাদীরাই আশা করতে পারেন যে এ যুদ্ধ ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল মার্ক মিলি সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, ‘ইউক্রেনে অধিকৃত ভূমি থেকে রাশিয়ানদের এ বছরের মধ্যে পুরোপুরি হটিয়ে দেওয়া খুব, খুব কঠিন একটি কাজ। এর মানে এই নয় যে সেটা করা যাবে না কিংবা সেটা হবে না, কিন্তু সেটা করা খুব, খুব কঠিন হবে।’

সম্প্রতি ২৮টি গণতান্ত্রিক দেশে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যে জরিপ চালানো হয়েছে, তার ফলাফলে উদ্বিগ্ন হওয়ারও কারণ আছে। কেননা, ৪২ শতাংশ মতামত প্রদানকারী এই মতের সঙ্গের ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে ‘ইউক্রেনের সমস্যা আমাদের বিষয় নয় এবং এ বিষয়ে আমাদের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।’

পশ্চিমা নেতাদের কখনোই যে যুক্তি পরিত্যাগ করা উচিত নয় তা হলো, স্বাধীনতার সুরক্ষা অনেক বেশি আমাদের বিষয়। স্বাধীনতার জন্য হস্তক্ষেপও বাধ্যতামূলক একটি বিষয়। গণতান্ত্রিক বিশ্বের ঐক্য ও সংকল্প শুরুতেই পুতিনকে বিস্মিত করেছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁর হৃদয় ভাঙা পর্যন্ত সেই ঐক্য ও সংকল্প অটুট রাখা প্রয়োজন।

  • দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ মনোজ দে
    আন্ড্রু রনসলি ব্রিটিশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক