ভ্লাদিমির পুতিনের ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর বছর পূর্তি হতে চলেছে। রুশ বাহিনী ইউক্রেনে যখন প্রথম আগ্রাসন শুরু করেছিল, তার থেকে এখন অনেকটাই ভিন্ন কৌশল নিয়ে লড়ছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কিয়েভে রাশিয়া যখন আক্রমণ শুরু করেছিল, তখন মনে হয়েছিল, জেলেনস্কি সরকারের উৎখাত করাই তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু শিগগিরই রুশদের কিয়েভ থেকে পিছু হটতে হলো। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর শক্তি ও সামর্থ্য বেড়েছে, বিষয়টি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একেবারেই উপেক্ষা করেছিলেন কিংবা তাঁর কাছে সে ধরনের তথ্য গোপন করা হয়েছিল। এরপরও যুদ্ধ শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রুশ বাহিনী পূর্ব ইউরোপের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নিয়েছিল।
যাহোক, রুশ বাহিনী শিগগিরই লড়াইয়ের মাঠে অগোছালো হয়ে পড়ে। রুশ বাহিনীকে হটিয়ে ২০২২ সালের শরৎকালে ইউক্রেনীয় বাহিনী বেশ কিছু ভূখণ্ড পুনর্দখলে নেয়। মস্কোর কৌশলগত যুদ্ধ কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়ে। কোনো পক্ষই এখন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তির মতো অবস্থায় পৌঁছায়নি। পশ্চিমা অনেক বিশ্লেষকের পূর্বাভাস সত্ত্বেও ইউক্রেনে রুশ বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েনি। এমনকি ছত্রভঙ্গ হতে পারে, এমন লক্ষণও নেই। কেন সেটা, তার ব্যাখ্যা দেওয়া হলো:
রুশ বাহিনীর পুনঃ সংস্থাপন
উত্তর কিয়েভ থেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণের ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি বিপর্যয়। সেই বিপর্যয়ের ফলাফল হলো পূর্বাঞ্চলে রাশিয়া তাদের বাহিনী পুনঃ সংস্থাপন করেছে। সরল কথায় পুনঃ সংস্থাপনের অর্থ হলো রাশিয়া ওই অঞ্চলে সামরিক রসদ ও সরঞ্জামের সঙ্গে সেনাশক্তি বাড়িয়েছে। আবার দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসন থেকে রাশিয়ার সেনাদের পশ্চাদপসরণের ফলাফলও একই।
বড় একটা যুদ্ধে লড়ার জন্য ইউক্রেনে তুলনামূলক অনেক ছোট বাহিনী নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। যদিও তথাকথিত সামরিক অভিযান শুরুর পর অনেকগুলো মাস পুতিন স্বীকার করেননি যে এটা সর্বাত্মক যুদ্ধ। কিন্তু পুতিন এখন নিশ্চিত করেই সেটা করছেন, তা সে কথায় কিংবা কাজে হোক। ইউক্রেনে রুশ সামরিক বাহিনীর বড় ধরনের শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে পুতিন তাঁর যুদ্ধকৌশলে পরিবর্তন এনেছেন। মজুত বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়ার পর ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের লোকবল বেড়েছে। এ মজুত বাহিনীর বেশির ভাগ অংশকে এখন পূর্বাঞ্চলে নিয়োজিত করা হয়েছে। সম্মুখসারির যোদ্ধাদের জন্য তারা প্রতিরক্ষাব্যূহ হিসেবে কাজ করছে। যুদ্ধে এ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানের মানে হচ্ছে, কমসংখ্যক সেনার প্রাণহানি এবং এক বছর আগের তুলনায় আক্রমণের জন্য বেশি পরিমাণ সম্পদের মজুত রয়েছে রাশিয়ার হাতে।
রাশিয়ার এখনকার আক্রমণাত্মক অভিযানের বড় একটি লক্ষ্য হচ্ছে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের মতো নিজেদের অধিকারে নেওয়া ভূখণ্ড নিরাপদে রাখা। রাশিয়া তাদের আগ্রাসনের পেছনে এটিকেই শক্ত যুক্তি হিসেবে হাজির করতে পারে।
গুঁড়িয়ে দিয়ে অগ্রসর হওয়া
দনবাসের বাখমুত অঞ্চলে রাশিয়ার বাহিনী খুব দ্রুত এগোতে পারছে না। কিন্তু রাশিয়ার বাহিনী অঞ্চলটি একপ্রকার গুঁড়িয়ে দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। যুদ্ধের শুরুতে ‘কমান্ড ও কন্ট্রোল’-এর যে সংকটে রাশিয়ার বাহিনী পড়েছিল, সে অবস্থা থেকে এখন অনেকটাই উত্তরণ হয়েছে। এর কারণ হলো অভিযানের ক্ষেত্র এখন অনেকটাই সীমিত করে ফেলেছে তারা। দেখা যাচ্ছে যে রাশিয়ার মজুত বাহিনী প্রথাগতভাবে কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। নিবিড় প্রশিক্ষণও পায়নি তারা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখনকার যুদ্ধের যে কৌশল, তাতে তারা বেশ ভালোভাবেই নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে।
রুশ বাহিনী এখন ভারী অস্ত্র ও দূরপাল্লার গোলার যুদ্ধে বেশ ভালো অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে রাশিয়ার বাহিনী যেভাবে হামলা শুরু করেছিল, সেটা ১৯৯৪ সালে চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিতে যে কৌশলে তারা আক্রমণ চালিয়েছিল, তারই পুনরাবৃত্তি। কিন্তু সাম্প্রতিক ব্যর্থতার পর তারা কৌশল পাল্টে ভারী ও দূরপাল্লার গোলানির্ভর যুদ্ধে মনোনিবেশ করে। নগর দখলে নিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত বাহিনী এ কৌশল প্রয়োগ করে। উপর্যুপরি গোলা ছুড়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর নগর দখলে নেওয়ার এ কৌশল সম্প্রতি মারিউপোল দখলে নিতে রুশ বাহিনী ব্যবহার করেছে।
ইউক্রেনের এ অনড় অবস্থান ন্যাটোর বিরুদ্ধে এত দিন ধরে রাশিয়া যে দাবি করে আসছিল, তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। পুতিন বলে আসছেন, ন্যাটোকে রাশিয়ার সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে পশ্চিমারা রাশিয়াকে ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায়।
পশ্চিম ও ন্যাটোর মধ্যে অবিশ্বাস
রুশ সেনাবাহিনী ক্ষয়ক্ষতি ও বড় ধাক্কা খাওয়ার পরও সাম্প্রতিক কিছু জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশটির জনগণ এখনো ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনে যুদ্ধরত সেনাদের জন্য এ সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত যতটা ভূখণ্ড রাশিয়া দখলে নিয়েছে, তার সবটাই পুনর্দখলে নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে ইউক্রেন। পশ্চিমারা তাতে সমর্থন দিয়েছে। ইউক্রেনের এ অনড় অবস্থান ন্যাটোর বিরুদ্ধে এত দিন ধরে রাশিয়া যে দাবি করে আসছিল, তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে। পুতিন বলে আসছেন, ন্যাটোকে রাশিয়ার সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করে পশ্চিমারা রাশিয়াকে ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চায়।
ক্রিমিয়াকে রুশরা নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করেন আর পশ্চিমারা উপদ্বীপটি পুনর্দখলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে দুই পক্ষই জনবল ও রসদের ঘাটতির মুখে পড়বে। রাশিয়ার বিশাল একটি মজুত বাহিনী আছে; সেই সঙ্গে ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মতো মিত্র আছে। আর অন্যদিকে ইউক্রেন ন্যাটোর শক্তিতে শক্তিশালী।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● আলেক্সান্ডার হিল কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক