কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে ধীরে ধীরে জয়ের দিকে যাচ্ছে। আবার ব্রিটেনের সেনাপ্রধান স্যার টনি র্যাডকিনের মতো কিছু মানুষ মনে করছেন, রাশিয়া এই যুদ্ধে ইতিমধ্যে হেরে গেছে এবং এখন কোনোরকমে টিকে থাকার জন্য দেশটি আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে বাস্তব অবস্থা হলো রাশিয়া দনবাসে তার অবস্থানকে সুসংহত করছে এবং তার স্থলবাহিনীকে একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দিতে এবং সেনাদের পুনঃসংগঠিত ও শক্তিশালী করতে লড়াইকে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখছে।
রুশ বাহিনীর আবার লড়াই শুরু করার অর্থ রাশিয়া পূর্ব এবং দক্ষিণ ইউক্রেনের বড় অংশকে নিজের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং এমনকি কিয়েভ দখলেরও হুমকি দেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া কিছু অস্ত্র ইউক্রেনীয়দের পরাজয় এড়াতে সাহায্য করেছে। প্রকাশিত অনেক রিপোর্ট বলছে, ইউক্রেনে সরবরাহ করা মার্কিন এইচআইএমএআরএস (হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম) রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর হয়েছে।
এই সমরাস্ত্র সিস্টেমটি কমপক্ষে একটি রাশিয়ান কমান্ড সেন্টার দখল করেছে, অনেক সিনিয়র রাশিয়ান অফিসারকে হত্যা করেছে এবং কমপক্ষে দুটি গুরুত্বপূর্ণ গোলাবারুদ ডাম্পের পাশাপাশি রাশিয়ান বিমান প্রতিরক্ষা এবং আর্টিলারি রকেট সিস্টেমগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
গ্রীষ্মের শেষে শীত এলেই ইউরোপে রাশিয়ান তেল এবং গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। এর জের ধরে ইউরোপীয়রা ইউক্রেনের ভবিষ্যতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংহতি ধরে রাখতে সক্ষম হবে না।
একই সময়ে রাশিয়ানরা কালিব্র থ্রি এম-৫৪ ক্রুজ মিসাইল ব্যবহার করে তাদের হামলার এলাকা প্রসারিত করেছে। পাঁচটি রাশিয়ান কালিব্র ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র মধ্য ইউক্রেনের ভিন্নিতসিয়া শহরের কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে। এতে কমপক্ষে ২৩ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে এবং আরও এক শ বা তার বেশি আহত হয়েছে।
গত সপ্তাহে কিয়েভে মার্কিন দূতাবাস ইউক্রেনে অবস্থানরত সব আমেরিকানকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘ব্যক্তিগত চেষ্টায় স্থল পরিবহন’ ব্যবহার করে চলে যেতে বলেছে। কারণ, দূতাবাস তাঁদের ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে সক্ষম নয়। এ ছাড়া দূতাবাস আমেরিকানদের সতর্ক করে বলেছে, যেন তাঁরা কোথাও জড়ো না হন; জড়ো হলে তাঁরা রুশ হামলার লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন।
মার্কিন দূতাবাসের বিজ্ঞপ্তিটি এ উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে যে রাশিয়া মার্কিন নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করবে। এই বিজ্ঞপ্তির পর ধারণা করা হচ্ছে, মার্কিন দূতাবাস মনে করছে, ইউক্রেনের যুদ্ধ আরও বিপজ্জনক পর্যায়ে মোড় নিতে যাচ্ছে।
রাশিয়া তার আইনসভার একটি অতি জরুরি অধিবেশন শুরু করেছে। অধিবেশনে আইনসভার স্পিকার ভ্যাচেস্লাভ ভোলোডিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যুদ্ধ চলতে থাকলে ইউক্রেন তার সার্বভৌমত্ব হারাতে পারে। এ মুহূর্তে আজভ সাগর এবং কৃষ্ণসাগর বরাবর দক্ষিণাঞ্চলের বেশির ভাগ এলাকা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে।
যদি রাশিয়া ক্রিমিয়ার মতো এই অঞ্চলটিকেও নিজের সঙ্গে সংযুক্ত করতে পারে, তাহলে পশ্চিমের খেরাসন থেকে মারিউপোল এবং সীমান্তের ওপারে রুশ শহর রোস্তভ-অন-দন পর্যন্ত বিস্তৃত শহরগুলোকে সংযুক্ত করবে। যে প্রধান শহরটি এখন পর্যন্ত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে নেই কিন্তু যার নিয়ন্ত্রণ নিতে রাশিয়া মরিয়া হয়ে উঠেছে, সেটি হলো ওডেসা।
মারিউপোল দখল করার পর লুহানস্ক এবং দনবাস অভিযানের সময় রুশ বাহিনী শুধু দক্ষিণে খেরাসনের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় একটি অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু রাশিয়ার জন্য দনবাসকে সংযুক্ত করতে আরও বড় ধাক্কা দিতে হবে।
ওডেসার ওপর স্থল আক্রমণের সম্ভাবনা বাড়াতে হবে। এটি বুঝেই ইউক্রেন দক্ষিণাঞ্চলে রুশ পদক্ষেপ ঠেকাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী রাশিয়ান কমান্ড সেন্টার এবং অস্ত্র ডিপোতে ভয়ংকর এইচআইএমএআরএস আক্রমণ চালিয়েছে।
তবে ইউক্রেনের রিপোর্ট অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেনের প্রায় ৮০ শতাংশ সামনের সারির (ফ্রন্টলাইন) যোদ্ধা নিহত, আহত বা যুদ্ধ থেকে ছিটকে পড়েছে। প্রেস রিপোর্ট বলছে, ইউক্রেনের যুবকদের মধ্যে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের উৎসাহ কম। অনেকেই দেশ ছেড়েছেন।
নতুন যঁাদের সেনা হিসেবে আনা হচ্ছে, তাঁদের মূল যোদ্ধাদের মতো প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা নেই। একইভাবে যুদ্ধে নিহত বিপুলসংখ্যক রাশিয়ান সেনার স্থলে রাশিয়া যাদের প্রতিস্থাপন করছে, তারাও আনাড়ি গোছের সেনা।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে যুদ্ধে টিকে থাকার এবং মস্কোর সঙ্গে আলোচনা না করার জন্য উৎসাহিত করে চলেছে। এ অবস্থায় মনে হচ্ছে রাশিয়া লুহানস্ক এবং দনবাসকে একীভূত করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং তা করতে পারলে তারা সেই অঞ্চলগুলোকে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
গ্রীষ্মের শেষে শীত এলেই ইউরোপে রাশিয়ান তেল এবং গ্যাসের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। এর জের ধরে ইউরোপীয়রা ইউক্রেনের ভবিষ্যতের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংহতি ধরে রাখতে সক্ষম হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে সমর্থন করা অব্যাহত রাখে এবং যুদ্ধবিরতির বিষয়ে জেলেনস্কি বিরোধিতাকে সমর্থন করতে থাকে তাহলে অন্তত কিছু ইউরোপীয় দেশ আগামী শীতে জ্বালানি সংকট থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে। আর সে অবস্থা তৈরি হলে ইউক্রেন যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাত্রা যুক্ত হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
স্টিফেন ব্রায়েন আমেরিকান সেন্টার ফর ডেমোক্রেসির সিনিয়র ফেলো