বহুদিন ধরে মনে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন দানা বাঁধছিল। সেগুলোর মধ্য থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জিজ্ঞাসা ছিল—এক, আমাদের দেশে একজনও কেজরিওয়াল জন্মায় না কেন? দুই, শুধু একটি বিষয়—‘দুর্নীতিবিরোধিতা’ দিয়েও তাহলে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূল পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত হওয়া সম্ভব? তিন, জনগণ আসলে কী চায়? রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এবং ক্ষমতার পালাবাদল, নাকি রাজনৈতিক সংস্কার? চার, কেজরিওয়ালের উত্থানের পেছনের মানুষগুলো কারা?
অর্থাৎ কারা তার পেছনে জড়ো হয়েছিল? জড়ো হওয়া মানুষদের সবাই কি তথাকথিত ‘নিরপেক্ষ’ ছিল? অর্থাৎ তারা কি মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কোনটিরই সমর্থক ছিল না? অবস্থা কি এমনটাই ছিল তাদের সমর্থন কংগ্রেসের জন্যও ছিল না, বিজেপির জন্যও না, সমাজতন্ত্রী দলগুলোর জন্যও না, স্থানীয়-আঞ্চলিক-জাতিগোষ্ঠীগত বা পেশাগোষ্ঠী কোনোটির জন্যও না? পাঁচ, উত্তর প্রদেশের জনগণ কি দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ অপেক্ষার পর অপেক্ষায় ছিল একজন কেজরিওয়াল আসবে; তারা তার পেছনে জড়ো হবে; তারপর দিন বদলাবে?
শেষের প্রশ্নটি ধরে উত্তর খুঁজতে নেমে বিষয়গুলো পরিষ্কার হতে শুরু করে একসময়। প্রথম অভিজ্ঞান—জনগণ কোনো ত্রাতার আগমনের অপেক্ষায় বসে থাকে না। দেশের সমস্যা জনগণের চৈত্র মাসি সমস্যা নয়। শুধুই মেঘের অপেক্ষা নয়। জনগণ কষ্টকর সময় গুনছে, সময়টি পেরোলেই শান্তি—এ রকম সাময়িক ঋতুকাল নয়। বরং রোগগ্রস্ত স্বদেশের পুরো বছরটিই চৈত্র মাস, দশকটিই চৈত্র মাস, যুগ যুগ চৈত্র মাস।
একজন পথপ্রদর্শক বা নেতা এসে আশার বাণী শোনাবেন, সাহস জোগাবেন—এ রকম দিবাস্বপ্ন দেখে অপেক্ষায় নামার সময় মানুষের হাতে থাকে না। ঘটনাপরম্পরায়, ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ভুক্তভোগী মানুষদের মধ্য হতে দু-একজন ছিটকে বেরিয়ে আসেন। এই দুই-একজন পেরেক-দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার যন্ত্রণা আর সইতে পারেন না বলেই সশব্দ চিৎকারে জানান দেন—আর মেনে নেওয়া নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আমজনতা কখন সেই সশব্দ চিৎকারকারীর পেছনে জড়ো হন? কেন শতকণ্ঠ হন? উত্তর—তখনই যখন তাঁরা নিশ্চিত হন সশব্দ চিৎকারটি যথার্থ আওয়াজ। দরকারি ও সময়ানুগ। বুলন্দ। পরিবর্তনের কথা বলছেন। দীর্ঘসূত্রী ও টেকসই পরিবর্তন চাইছেন। ক্ষমতার হাতবদল-পালাবদল, একদলের হাত হতে অন্য দলের হাতে গেলেই সমাধান—এ রকম ভাবছেন না।
সবচেয়ে বড় কথা তাঁরা নিশ্চিত সশব্দ আওয়াজকারী সৎ, নির্ভরযোগ্য, নিঃস্বার্থ। চিৎকারের পেছনে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। জনমন পাঠ করতে পেরেছেন। সবার প্রাণের চাওয়াটিকে তুলে এনেছেন। যেমন ‘দুর্নীতি’। এ এক ক্যানসার। ভারতের গায়ে-গিঁটে-তলপেটে-হৃদ্যন্ত্রে অজস্র রোগ। অপরিসীম ব্যথা। অসংখ্য কলঙ্কের দাগ। বর্ণাশ্রম, উগ্র হিন্দুত্ববাদ, সাম্প্রদায়িকতা, আদিবাসী ও জাতিগোষ্ঠীগত বিভাজন—কী নেই অসুখের তালিকায়। কেজরিওয়াল সব রোগ সারানোর দাবি তোলেননি। ভেবেচিন্তে বেছে বেছে সবচেয়ে আগ্রাসী—ক্যানসারের মতো ভারত দেহের পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়া রোগটিকে ধরে নিরাময়ের দাবি তুললেন।
দুর্নীতির একই ক্যানসার বাংলাদেশ-দেহের কোষে-কোষেও ছড়িয়েছে। কিন্তু এখানে একজন কেজরিওয়ালের উত্থান হয়নি। কারণ, সংস্কারকদের উত্থানের মূল শর্ত ‘আইনের শাসন’। বাংলাদেশে বিচারিক স্বাধীনতা ধ্বংসপ্রায়। কেজরিওয়ালের উত্থানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। ভারতের প্রতিষ্ঠানটি এখনো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। বাংলাদেশে উল্টো। কেজরিওয়ালের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান-অনশনকালে এবং আগে-পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সব বাধা, পুলিশি ব্যবস্থা মামলা-হামলা, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, চোখরাঙানি প্রায় সবকিছুই আদালত অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেন। বর্তমানের কথাই ধরা যাক।
উত্তর প্রদেশে তো বটেই, দেশজুড়ে কেজরিওয়ালের আম-আদমি পার্টির বাড়ন্ত জনপ্রিয়তা ঠেকাতে এমন কোনো চেষ্টা নেই, মোদি সরকার করছে না। কেন্দ্র একটি অধ্যাদেশ করেছে। অধ্যাদেশে দিল্লি মনোনীত অনির্বাচিত উপরাজ্যপালকে দিল্লির প্রশাসনিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশ মোতাবেক জনপ্রশাসনের নিয়োগ-বদলির দায়িত্ব উপরাজ্যপালের। কেজরিওয়াল আদালতে গেলেন। এ বছরের ১১ মে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে রায় দিলেন এই অধিকারটি শুধুই রাজ্য সরকারের।
উপরাজ্যপালকে রায়টি মানতে হবে। কেন্দ্র শুধুই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ও জমিজমা-সম্পর্কিত বিষয়-আশয় দেখবে।
তবু মোদি সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায়কে পাশ কাটিয়ে অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। কেজরিওয়ালও তার সব ক্ষমতা নিয়েই লড়ছেন। বিজেপির মতো কংগ্রেসও আম-আদমি পার্টির (আআপ) উত্থানকে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীর উত্থান বিবেচনায় শঙ্কিত। তবু আদর্শিক কারণে কংগ্রেস কেজরিওয়ালের পক্ষ নিয়েছে। এবারও সুপ্রিম কোর্ট অধ্যাদেশটিকে আইনে পরিণত করতে বিজেপি সরকারের চেষ্টাকে ঠেকিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশে বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও রাজনীতিমুক্ত রাখা গেলে এখানেও কেজরিওয়ালদের উত্থান অসম্ভব নয়।
বোঝা দরকার হিরো আলম কেন জনপ্রিয় হন। কারণ যথেষ্টই রয়েছে। অন্ত্যজ আমজনতা তাঁকে ‘নিজেদের লোক’ ভাবছে—শুধু এ কারণে অবশ্যই নয়। বরং সমর্থন ও ভালোবাসা তাঁর প্রাপ্য বলেই আমজনতা ভালোবাসছে। জনমানসে হিরো আলমের পর্যায়ের সততা, সত্যবাদিতা, অকৃত্রিমতা, সারল্য এবং সাহসী ও অকপট উচ্চারণ করতে পারার গুণ জাতীয় পর্যায়ের কয়েকজন রাজনীতিক বা বিজ্ঞজনের রয়েছে? আমজনতা জনতার মুখপাত্রদের মধ্যে এসব গুণ দেখতে চায়।
কেজরিওয়ালের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে শামিল হওয়া মানুষগুলো আসমান থেকে নেমে আসেননি। তাঁরা হয় কংগ্রেসের, নয় বিজেপির, নয় সমাজতন্ত্রী দলগুলোর অথবা আন্তরাষ্ট্রীয় জোট-মোর্চাগুলোর কোনো না কোনোটিকে সমর্থন করতেন বা ভোট দিতেন। তাঁরা জড়ো হলেন কারণ ক্যানসার সারানো সংস্কারই বেশি দরকার। ক্ষমতার বা দলের হাতবদলে আমজনতার উপকার সামান্যই। বাংলাদেশ কেন, কোনো দেশই এর ব্যতিক্রম নয়। সংস্কার এগিয়ে নেওয়ার জন্য রাজনৈতিক ভিত্তি দরকার। যেভাবে আম-আদমি পার্টির জন্ম।
বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি দুটি ভুঁইফোড় রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্য বিবেচনা করেছে। (কোনো সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে দলের লোকগুলোর একজনকেও কোনো দিন মাঠে-ময়দানে কেউ দেখেছে কি? দল দুটির নাম, নেতা, কর্মী উদ্দেশ্য-বিধেয় কেউ কস্মিনকালেও শুনেছে কি? দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের মুখ দিয়ে একটি শব্দও বেরিয়েছে কি? বলা-কওয়া নেই, দল জন্ম নিয়ে আঁতুড়ঘর হতেই নির্বাচনী হাঁক হাঁকছে। যেন একটি শিশু নাড়ি কাটার আগেই দাবি করে বসছে সে বাবা হতে চলেছে। )
এদিকে সংস্কারহীন ফাঁপা শূন্যতার কালে হিরো আলম আলোচিত হয়ে উঠেছেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দৃষ্টিভঙ্গি, দূরদৃষ্টি বা সংস্কারমুখী সমাজভাবনা আদতেই কিছু নেই। সমাজের কোনো একটি ক্যানসারকে (যেমন দুর্নীতি) ঠেকানোর আন্দোলন দূরে থাকুক, বোঝার সক্ষমতাও হয়তো তাঁর নেই। তিনিও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বা সমাজ-সংস্কারের পক্ষে কখনো কিছু বলেননি। কখনো বলবেন মনেও হয় না। নিজেও কখনোই হয়তো ভাবেননি ভাগ্য তাঁকে এত দূর নিয়ে আসবে। জাতিসংঘেও তার নাম উচ্চারিত হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের হাসি-ঠাট্টা-ট্রল, মাস্তি-মশকারার মাধ্যমে হিরো আলমের পরিচিতি বেড়েছে। অনেকটা না চাইতেই বৃষ্টির মতো। দু-এক বছরের মধ্যেই হয়তো তিনি অপ্রাসঙ্গিক ও অনালোচিত হয়ে পড়বেন। কেজরিওয়ালের সঙ্গে তাঁর তুলনা কোনোভাবেই চলে না। তুলনা এই আলোচনার উদ্দেশ্যও নয়। বরং উদ্দেশ্য এই সত্যটির দিকে নজর ফেরানো যে কেজরিওয়ালের মতো সচেতন সংস্কারকের উত্থান দরকার। তা না হলে শূন্যস্থানে হিরো আলমের মতো অনুপযুক্ত ও সংকল্প-সম্ভাবনাহীন কোনো না কোনো চরিত্রের উত্থান ঘটবে।
বোঝা দরকার হিরো আলম কেন জনপ্রিয় হন। কারণ যথেষ্টই রয়েছে। অন্ত্যজ আমজনতা তাঁকে ‘নিজেদের লোক’ ভাবছে—শুধু এ কারণে অবশ্যই নয়। বরং সমর্থন ও ভালোবাসা তাঁর প্রাপ্য বলেই আমজনতা ভালোবাসছে। জনমানসে হিরো আলমের পর্যায়ের সততা, সত্যবাদিতা, অকৃত্রিমতা, সারল্য এবং সাহসী ও অকপট উচ্চারণ করতে পারার গুণ জাতীয় পর্যায়ের কয়েকজন রাজনীতিক বা বিজ্ঞজনের রয়েছে? আমজনতা জনতার মুখপাত্রদের মধ্যে এসব গুণ দেখতে চায়। কেজরিওয়ালের মতো শিক্ষাদীক্ষা, অনুধাবন, বোধবুদ্ধি বা সংকল্প হিরো আলমের নেই। বাকি আধাআধি অন্যান্য গুণ রয়েছেই। তাই ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা’ হিসেবেই পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন হিরো আলম।
আম-মানুষ পরিবর্তন চায়, নতুন মুখপাত্র চায়। সমাজে ক্যানসারের মতো বাসা বাঁধা রোগ নিরাময়ে উচ্চকণ্ঠ পথ দেখানেওয়ালা চায়। বাংলাদেশে কেজরিওয়াল পর্যায়ের অন্তত একজন উঠে আসুক। কেজরিওয়াল না মিললে হিরো আলমই মিলবে শেষতক। ফলাফল হবে পর্বতের মূষিক প্রসব।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।