নির্বাচনের সঙ্গে অর্থনীতির সম্পর্ক নিয়ে শেষ কথাটা বলে গিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার জেমস কার্ভিল। ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিল ক্লিনটনের প্রতিপক্ষ ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। ইরাকের কুয়েত আক্রমণ এবং উপসাগরীয় যুদ্ধের কারণে ১৯৯১ সালেও জর্জ বুশের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী।
কিন্তু এক বছরের মধ্যেই সেই জনপ্রিয়তায় ধস নামে। অর্থনীতির মন্দাই এর প্রধান কারণ। মূল্যস্ফীতি ছিল বেশি, চাকরি হারানোর শঙ্কায় ছিল মার্কিনিরা। এ রকম এক সময় মার্কিন নাগরিকেরা বুশকে নয়, ক্লিনটনকে কেন ভোট দেবেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে জেমস কার্ভিল একটা কথাই বলতেন, ‘ইটজ দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’।
এর আগে ১৯৮১ সালে জিমি কার্টারকে হারিয়ে যখন রোনাল্ড রিগ্যান প্রেসিডেন্ট হন, তখনো মার্কিন অর্থনীতি ছিল ভয়াবহ মন্দায়, মূল্যস্ফীতির চাপে দিশাহারা ছিল প্রায় গোটা বিশ্ব। সেবারও মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছিল ভদ্রলোক কার্টারকে। তবে অর্থনীতির সঙ্গে যে নির্বাচনের একটা সম্পর্ক আছে, সেই আলোচনা জোরালোভাবে শুরু হয় ক্লিনটনের সময় থেকেই।
এ কারণেই ৩১ বছর আগের সেই কথাটা রাজনৈতিক অভিধানে বেশ ভালোভাবেই ঢুকে গেছে। জো বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্রেও সামনে নির্বাচন। ফলে আবারও বলা শুরু হয়েছে অর্থনীতির কথা। বলা হয়, এটাই নির্বাচন জেতার আসল মন্ত্র। ল্যারি বারটেলস হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নামকরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। তিনি এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ১ শতাংশ বাড়লে ক্ষমতাসীন দলের ভোটও বাড়ে ১ শতাংশ।
উন্নত দেশগুলোতে ভিন্ন চিত্রও অবশ্য আছে। তবে অর্থনীতির প্রভাব একেবারেই বিদায় নেয়নি। বরং নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে কট্টর জাতীয়তাবাদ ও বিশ্বায়নের প্রভাব অনেক বেশি কাজ করছে। যেমন ইতালির মিলানের দুই অর্থনীতিবিদ ইতালো কোলান্তনে ও পিয়েরো স্তানিজ ইউরোপের ১৫টি দেশের নির্বাচনী ফলাফলের ওপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন, যেসব এলাকায় সস্তা চীনা পণ্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র, সেসব এলাকায় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো বেশি ভোট পেয়েছে।
আবার ২০১৮ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তিন গবেষক কার্ল বেনেডিক্ট, থর বারজার ও চিনচি চেন দেখিয়েছেন, ২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যেসব রাজ্যে রোবট কাজের জায়গা বেশি দখল করছে, প্রযুক্তিগত অটোমেশন বেশি হয়েছে, সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প বেশি ভোট পেয়েছেন। বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে যদি অটোমেশন প্রক্রিয়া এতটা দ্রুত না হতো, তাহলে মিশিগান, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিনে হয়তো হিলারি ক্লিনটনই বিজয়ী হতেন।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রে অনেক ঘাটতি ছিল। তারপরও নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্র টিকে ছিল। এখন সেটাও নেই। ফলে ভোটারের স্বস্তি বা অস্বস্তি—কোনোটাই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিবেচ্য বিষয় আর নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভোট, রাতের ভোট আর এবার সমঝোতার ভোট—এখানে ভোটারের কোনো ভূমিকা নেই। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘ইটস নট দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’।
রোবট, বাড়ির দাম অথবা বিশ্বায়ন—সবই মূলত উন্নত দেশগুলোর উদ্বেগের বিষয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলোই আসলে বেশি প্রভাবিত করে। আর এ নিয়ে গবেষণাও আছে অসংখ্য। নোবেল বিজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলিয়াম ডি নর্ডহাউস ১৯৭৫ সালে ‘রাজনৈতিক বাণিজ্যিক চক্র’ নামের এক তত্ত্ব দিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচনী বছরে ভোটারদের খুশি করতে সরকারগুলো খরচ অনেক বাড়িয়ে দেয়। নানা ধরনের করছাড় দেওয়া হয়। ফলে বাজেট ঘাটতিও বাড়ে।
অথচ এভাবে অর্থ খরচের কারণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে, যা সরকারগুলো উপেক্ষা করে। গবেষণায় এমনও দেখা গেছে যে সরকারি দল ডানপন্থী হলে তারা নির্বাচনী বছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দেয়, আর বামপন্থীরা গুরুত্ব দেয় কর্মসংস্থানকে। তবে সাধারণভাবে নির্বাচনী বছরে যথেচ্ছ খরচ করার দিকেই আগ্রহ বেশি থাকে। যেমন এসব দেশে গণমাধ্যম থাকে সরকারনিয়ন্ত্রিত বা সরকার তাদের স্বাধীনতা খর্ব করে, নাগরিকেরা পর্যাপ্ত তথ্য পায় না, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকে দুর্বল। ফলে আর্থিক খাতকে নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবহার করা হয় যথেচ্ছভাবে।
মুশকিল হয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে। বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ নির্বাচনকালীন অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে যত গবেষণা করেছেন, কোনোটার সঙ্গেই ঠিক মিলছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিজেই বলেছেন, তিনি তাঁর ৩৬ বছরের চাকরিজীবনে অর্থনীতির এতটা খারাপ অবস্থা কখনো দেখেননি। দেশের অর্থনীতি প্রায় দুই বছর ধরেই সংকটে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার-সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন, বিনিয়োগে মন্দা, জ্বালানিসংকট, আর্থিক হিসাবে ভারসাম্যহীনতা—সংকট আসলে প্রায় সব সূচকেই। ৮৬ টাকার ডলার এখন ১১০ টাকা বলা হলেও, কার্যত তা প্রায় ১২৫ টাকায় উঠে গেছে।
প্রতি মাসে রিজার্ভ কমেছে ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার করে। দুই বছরে রিজার্ভ অর্ধেক হয়ে গেছে। ১০ বছরের মধ্যে প্রথম দেখা দিয়েছে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতি। মূল্যস্ফীতি গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ। রপ্তানি আয়ে খানিকটা স্বস্তি থাকলেও টানা দুই মাস ধরে সেখানেও ঘাটতি। তীব্র জ্বালানিসংকটের অর্থই হচ্ছে কম কর্মসংস্থান ও উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়। অনেক ধরনের উদ্যোগ নিয়েও প্রবাসী আয়েও প্রবৃদ্ধি খুবই কম। এর সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা।
গভর্নরের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনীতি একেবারে তলানিতে আছে এবং এর চেয়ে আরও খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কেন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো দল বা ভোটারদের কাছে অ্যাজেন্ডা হিসেবে স্থানই পাচ্ছে না। যেকোনো বিচারেই এটা ভোট পাওয়ার জন্য আদর্শ পরিস্থিতি নয়। এ রকম এক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে কোনো ক্ষমতাসীন দলেরই নির্বাচন নিয়ে স্বস্তিতে থাকার কথাও নয়। অথচ অর্থনীতি নিয়ে সব আলোচনাই ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। যা-ই হোক না কেন, নির্বাচনের পরে দেখা যাবে।
পাশের দেশ ভারতের কথাই ধরা যাক। চলতি বছর তারা প্রথমে চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে, আর সম্প্রতি পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনীতি আছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন সামনে রেখেই এ সিদ্ধান্ত। কারণ, মোদি সরকার চায় না রান্নাঘরের উত্তাপ নির্বাচনে এসে লাগুক।
কেননা, ভারতে পেঁয়াজের দাম অতীতে সরকারকে ফেলে দিয়েছে, এমন উদাহরণও আছে। ১৯৮১ সালে ভারতের প্রথম অ-কংগ্রেসীয় সরকার জনতা দলের পতনের বড় কারণ ছিল পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা। ইন্দিরা গান্ধী এ সময় জিতে এসে একে বলেছিলেন, ‘ওনিয়ন ইলেকশন’। আবার ১৯৯৮ সালে বিজেপি দিল্লিতে হেরেছিল পেঁয়াজের দামের কারণেই। বলাই হয়, ভারতে নির্বাচনে প্রধান অ্যাজেন্ডার নামই হচ্ছে ‘টিওপি বা টপ’। এর অর্থ হচ্ছে টমেটো, ওনিয়ন ও পটেটো। অর্থাৎ টমেটো, পেঁয়াজ ও আলুর দর ঠিক রাখতে পারলেই নির্বাচনে পার পাওয়া অনেক সহজ।
অথচ আমাদের এই বাংলাদেশে পেঁয়াজ হাঁকিয়েছে দ্বিশতক, দীর্ঘদিন ধরে মোটা চালের দরই ৪৮ টাকা আর আলুর দাম নিয়ে ঘটে গেছে তুলকালাম সব কাণ্ড। কিন্তু তাতে কী? বাজারের আগুন রান্নাঘরে চলে এসেছে, আর নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল নির্ভার—এমন ঘটনা বিশ্বে বিরল, বিশেষ করে যেখানে গণতন্ত্র আছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রে অনেক ঘাটতি ছিল। তারপরও নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতন্ত্র টিকে ছিল। এখন সেটাও নেই। ফলে ভোটারের স্বস্তি বা অস্বস্তি—কোনোটাই রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বিবেচ্য বিষয় আর নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভোট, রাতের ভোট আর এবার সমঝোতার ভোট—এখানে ভোটারের কোনো ভূমিকা নেই। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘ইটস নট দ্য ইকোনমি, স্টুপিড’।
আবার এমন নয় যে নির্বাচন শেষ হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। শীত এসেছে বলে বিদ্যুৎ-সংকট থেকে খানিকটা স্বস্তি পাওয়া গেছে, আর বাজারে সবজির দরও খানিকটা কমেছে। এতে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি দিচ্ছে। তবে এটুকু স্বস্তি সংকট কাটাবে না। গভর্নর বলছেন, মার্চে সংকট কাটবে। যদিও তাঁর এ ধরনের প্রতিশ্রুতি কয়েক মাস পরপর নবায়ন করতে হয়। সংকট কাটানোর ম্যাজিক তো তাঁর হাতে নেই। রাজনৈতিক অঙ্গীকারও দেখা যায়নি। ফলে নির্বাচনের সময় যতই আমরা চোখ বন্ধ করে থাকি না কেন, নির্বাচনের পরে অর্থনীতিকে ১ নম্বর অ্যাজেন্ডা বানাতেই হবে। নইলে সামনে বিপদ।
শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন