মরণসাগরপারে রতন সরকার

রতন সরকার

সদ্য প্রয়াত সময় টেলিভিশনের রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক রতন সরকারকে ভোলা সহজ নয়। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে ১৩ জুলাই দিবাগত রাত ১২টায় তিনি মারা গেছেন। ইহজাগতিকতা ছেড়ে তিনি এখন মাটি ও মহাকালের অংশ।

উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে, স্কুলপড়ুয়া মেয়ে পিতৃহীন হলো। পরিবারের অন্যরা কীভাবে সহ্য করবেন, তা জানি না। রতন সরকারের মতো সন্তানের বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান হওয়া মানে একটি দুশ্চিন্তা সব সময় বহন করে চলা। তোষামোদকারীতে ভরা সমাজে রতন সরকার যে পথে হেঁটেছেন, সে পথ কণ্টকাকীর্ণ, বড় একাকিত্বের।

তবু অনেকেই তার পাশে ছিলেন। কদিন আগেই মারা গেলেন বিশিষ্ট ভাওয়াইয়া শিল্পী সালমা মোস্তাফিজ, মারা গেলেন রংপুর মহিলা পরিষদের সভাপতি হাসনা চৌধুরী। সেই শোকভরা রংপুরে মারা গেলেন রতন সরকার।

রতন সরকারের এক যুগ আগেকার কথা কানে বাজছে। টেলিভিশনের প্রতিবেদনের জন্য বক্তব্য নেওয়ার পর বলেছিলেন, ‘স্যার দীর্ঘসূত্রতা শব্দটা পরিবর্তন করে সহজ শব্দ বললে ভালো হয়। চায়ের দোকানে বসেও সাধারণ মানুষ আমার রিপোর্ট দেখবে। সেখানে এমন শব্দ থাকুক, যাতে সবাই বুঝতে পারে।’ রতন সরকার এভাবেই সাজাতেন তাঁর প্রতিবেদন। শব্দ ব্যবহারে দর্শক-শ্রোতাদের কথা মাথায় রেখে কাজ করতেন।

আমরা যাঁরা ‘তিস্তা’ ইস্যুকে ২০১০ সাল থেকে সরব রেখেছি, তাঁদের মধ্যে রতন সরকার অন্যতম। তিস্তা নদী নিয়ে আমরা অনেক দিন একসঙ্গে কাজ করেছি। তিস্তা ইস্যুতে নদীতে আমাদের কোনো কর্মসূচি থাকলেই রতন সরকার যেতেন। ২০১১ সালে যখন তিস্তা চুক্তি হলো না, তখন আমরা খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। একবার ইংরেজিতে মানুষ দিয়ে ‘সেভ তিস্তা’ লেখা হলো, সেবার অনেক সময় ছিলেন রতন সরকার। তিস্তায় নৌকা-বৈঠক করলাম, সেখানে সময় টিভি ছিল। কলসে পানি ঢেলে প্রতিবাদ জানালাম, সেখানেও সময় টেলিভিশন ছিল। এমনও হয়েছে, কেবল একটি গণমাধ্যম আছে, সেটি রতন সরকারের। বর্তমানে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের যেকোনো কর্মসূচিতে অনেক গণমাধ্যমকর্মীর মতো তাঁর সরব উপস্থিতি থাকত।

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটালেন রংপুরে রতন সরকার। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল অনেক। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর একটি জানাজা রংপুরে হলে শ্রদ্ধা জানানোর কোনো আয়োজন থাকলে ভালো হতো। জানাজা ও দাফন হয়েছে নীলফামারীতে। রতন সরকার বেঁচে নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলি, ‘নয়নসম্মুখে তুমি নাই/ নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’ ‘মরণসাগরপারে’ যাঁরা অমর থাকেন, তাঁদের সারিতে থাকুক রতন সরকার।

আমরা নদী নিয়ে কাজ শুরু করার দিনগুলোতে রতন সরকারও কাজ করছিলেন। আমরা দুজনে মিলে নদী-বিষয়ক পড়ালেখা করতাম। তিনিও সরেজমিনে নদী দেখে আসেন, আমি দেখে আসি। তারপর দুজন বসে সেই দেখে আসা নদী নিয়ে পর্যালোচনা করি। এভাবে সমৃদ্ধ হয়েছি।

তিস্তা নদীতে একটি মহাপরিকল্পনার আলোচনা চলছে। রতন সরকার সাংবাদিকতারও ঊর্ধ্বে উঠে বারবার চেয়েছেন—তিস্তা মহাপরিকল্পনা হতেই হবে। তিস্তা নদী উত্তরের জীবনরেখা। অথচ তিস্তাই অভিশাপে পরিণত হয়েছে। সেটিকে আশীর্বাদে পরিণত করার জন্য তাঁর নিজের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। রতন সরকার সর্বশেষ যে স্ট্যাটাস ফেসবুকে দিয়েছেন, অনুমান করি সেটিও তিস্তার জন্য। তিনি তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কয়েক শীর্ষ সংগঠকসহ ঢাকায় গিয়েছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে মহাপরিকল্পনাবিষয়ক আলোচনা করতে। যাওয়ার আগে ফেসবুকে দেওয়া তাঁর শেষ স্ট্যাটাস—‘সর্বোচ্চ ত্যাগের শপথ আর কোটি মানুষের স্বপ্ন নিয়ে পা বাড়ালাম। দোয়া করো উত্তরের ধূলিকণা, পানি ও বাতাস”। তাঁর এই স্ট্যাটাস যে তিস্তা নদীকে ঘিরে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

রতন সরকার অনেক দিন আমাকে বলেছেন, ‘অনেকে বলেন, রিপোর্টের নাকি বিষয় পাওয়া যায় না। অথচ নিউজ করতে চাইলে বিষয়ের কোনো অভাব নেই।’ তিনি মফস্‌সল সাংবাদিকতা নিয়ে একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি লিখেছিলেন। কয়েক বছর আগে আমার কাছ থেকে ভূমিকাও লিখে নিয়েছিলেন। বইটি সম্ভবত প্রকাশিত হয়নি।
রতন সরকারের অনেক প্রতিবেদন নিয়ে বিতর্ক আছে। আছে বড় বড় মামলা-মোকদ্দমা। মামলার কারণে অনেক দিন তাঁকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়েছে।

সেসব কিছুর মূল্যায়ন এখন আর তাঁকে স্পর্শ করবে না। কেউ কেউ তাঁকে চারণ সাংবাদিক বলতেন, অনেকেই কালজয়ী সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করতেন। তবে প্রকৃত মানুষ যেমন দোষে-গুণে হন, রতন সরকারও তেমনি।
১৩ জুলাই সকালে ঢাকায় গিয়ে ওই দিন রাত সাড়ে ১০টায় রংপুরে ফিরেছিলেন। একটি অনলাইন টেলিভিশনের ভিডিও চিত্রসূত্রে জানলাম, রংপুরে বাসায় না ফিরে তমাল নামের এক ড্রাইভারের গাড়িতে তিনজন মিলে গিয়েছিলেন রংপুর শহর থেকে আরও প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে চওড়ারহাট নামের প্রান্তিক এলাকায়। রাত ১১টার পর সেখানে একটি বাড়ির পাশে গিয়েছিলেন প্রাকৃতিক কাজে। ওই সূত্রে জানা যায়, সেখানেই তিনি জ্ঞান হারান। সেখান থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয় অ্যাম্বুলেন্সে। তাঁর আর জ্ঞান ফেরেনি। তিনি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ছিলেন বলেও জানা যায়।

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটালেন রংপুরে রতন সরকার। তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী ছিল অনেক। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর একটি জানাজা রংপুরে হলে শ্রদ্ধা জানানোর কোনো আয়োজন থাকলে ভালো হতো। জানাজা ও দাফন হয়েছে নীলফামারীতে। রতন সরকার বেঁচে নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলি, ‘নয়নসম্মুখে তুমি নাই/ নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।’ ‘মরণসাগরপারে’ যাঁরা অমর থাকেন, তাঁদের সারিতে থাকুক রতন সরকার।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক