বিবিধ বাহাসে ফিকে হয়ে আসে গ্রাফিতি

‘জুলাইয়ে আমরা ঐকমত্যের যে পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম, সে রকম একতা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।’

দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলো ফিকে হয়ে আসছে। মলিন হয়ে আসছে হৃদয় নিংড়ে বেরিয়ে আসা রঙের আঁচড়গুলো। জুলাই অভ্যুত্থানের তিন মাস পেরিয়ে গেল। হাজারো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত ৩৬ জুলাইয়ের মুক্তির পর যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তাতে কোনো সীমারেখা টানিনি কেউ। সব মত আর পথ সেদিন এসে মিশেছিল ঢাকার রাজপথে। এমন জাতীয় ঐক্য শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, বোধ করি, পৃথিবীতেই বিরল।

কিন্তু যেখানে আর দশটা আন্দোলন কিংবা আমাদেরই ইতিহাসের সঙ্গে ৩৬ জুলাইয়ের পরের দিনগুলো মিলে যায়, তা হচ্ছে আন্দোলনের পরের দিনগুলোতে খানিকটা আশা ভঙ্গ, কিছুটা সংশয় আর গণ-অভ্যুত্থানের সম্মিলিত শক্তির বাঁধন আলগা হয়ে আসার প্রবণতা।

বাংলাদেশে যখন লাখো জনতা পথে নেমে নিজেদের অধিকার আদায় করে নিয়েছে, তখন অনেকে এই অভ্যুত্থানের তুলনা করেছেন আরব বসন্তের সঙ্গে। আশঙ্কা করেছেন আরব বসন্তের মতোই আমাদের অর্জন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সে তুলনা অমূলক নয়, কিন্তু আরব বসন্ত থেকে শিক্ষা নিলে মিসর কিংবা সুদানের মতো দেশের পরিণতি এড়িয়ে অন্তত শ্রীলঙ্কার পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

মিসরে তিন দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা হোসনি মোবারক জনতার প্রতিবাদের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন ২০১১ সালে। তাহরির স্কয়ারে সম্মিলিত জনতা তখন স্বপ্ন দেখেছিলেন নতুন এক মিসরের, যেখানে গণতন্ত্র মুক্তি পাবে, মানুষ পাবে অধিকার। বছর না ঘুরতেই সে দেশে নির্বাচন হয়, পরের বছর ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুড–সমর্থিত মোহাম্মদ মুরসি। কিন্তু নতুন দেশ গঠনে জাতীয় ঐক্য থেকে যায় সুদূরপরাহত। অভ্যুত্থানে সম্মিলিত শক্তিগুলোর মধ্যে বিবাদগুলো প্রকাশ্যে আসতে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত।

অভিযোগ আছে, এ সংঘাত ছড়িয়ে দিতে পর্দার আড়ালে ভূমিকা রাখে দেশটির সামরিক বাহিনী। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে রাজপথে বড় রকমের সংঘাতে জড়ায় মুরসির দল আর তাদের প্রতিপক্ষরা। এরপর জাতীয় সংলাপের ডাক সরকারের তরফ থেকে দেওয়া হলেও তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

অভ্যুত্থানের আড়াই বছরের মাথায় ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয় সেনাবাহিনী। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ফিল্ড মার্শাল আল-সিসি ৯৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। শুরু হয় মিসরের স্বৈরতন্ত্রের নতুন অধ্যায়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আফ্রিকার আরেক দেশ সুদানে গণ-অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়। সে দেশেও রাষ্ট্রপতি ওমর আল বশির ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে এসে ঠেকেছিল, দ্রব্যমূল্য হয়েছিল তিন গুণ।

২০১৯ সালের এপ্রিলে জনতার বিক্ষোভের মুখে আল বশিরকে গ্রেপ্তার করে দেশটির সেনাবাহিনী, জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। সে বছরের জুলাইয়ে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত শক্তিগুলোর চুক্তি সই হয়। লক্ষ্য ছিল সংস্কার ও গণতন্ত্রায়ণ। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন আবদুল্লাহ হামদক। তাঁর ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি, কাজ করেছিলেন জাতিসংঘের সঙ্গেও। শুরু হয় সংস্কারের নানা উদ্যোগ।

পুরোনো ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন দেশ গড়ার উদ্যোগ যেমন চলছিল, তেমনি অভ্যুত্থানের শক্তির মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টাও থেমে ছিল না। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়ে সুদানের অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শক্তিগুলো। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কথা ছিল সামরিক-বেসামরিক শক্তির সমন্বয়ে গঠিত যৌথ একটি কাউন্সিলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার। কিন্তু তার আগেই ২০২১ সালের অক্টোবরে সামরিক ক্যুতে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেওয়া হয় হামদককে। আবারও শুরু হয় বিক্ষোভ, অস্থিরতা। এখন সুদানে সামরিক বাহিনী আর মিলিশিয়ার মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেছে, প্রাণ হারাচ্ছে হাজারো নিরীহ মানুষ।

জুলাইয়ে আমরা ঐকমত্যের যে পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম, সে রকম একতা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। একতা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তারপর কিছুটা হলেও বিভেদ আসবে এটাই স্বাভাবিক। সর্বোচ্চ একতার পরের সময়গুলোতে ঐক্যে কিছুটা শিথিলতা অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাস তা–ই বলে। প্রশ্ন হলো, মতবিরোধের এ পর্যায়ে আমরা কতটা যৌক্তিক আচরণ করতে পারি, যাতে কিছু ন্যূনতম প্রশ্নে ঐক্য ধরে রাখা যায়।

২০২২ সালের জুলাইয়ে সীমাহীন দুর্নীতি আর অসহনীয় দ্রব্যমূল্য শ্রীলঙ্কার মানুষকে রাস্তায় নিয়ে আসে। দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে ‘গোটা গো হোম’ স্লোগান তুলে দেশ থেকে হটিয়ে দিতে সমর্থ হন শ্রীলঙ্কার জনতা। গৃহযুদ্ধের ক্ষত, সিংহলি-তামিল বিরোধ শ্রীলঙ্কার পুরোনো সমস্যা। একদিকে চীন, অন্যদিকে ভারতের চাপ সামলে চলতে হয় এই দ্বীপরাষ্ট্রকে। তারপরও সে দেশের তরুণ প্রজন্ম সব বিভেদকে দূরে ঠেলে গণতন্ত্রের দিকে হাঁটছে।

সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রশ্নে বিভেদ তৈরির চেষ্টা যে সেখানে নেই তা নয়, কিন্তু দেশের প্রশ্নে, গণতন্ত্রের প্রশ্নে এবং ন্যূনতম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে দেশটির তারুণ্য এখনো এককাট্টা। শ্রীলঙ্কায় দ্রব্যমূল্য এখন কমতির দিকে, নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন আশায় বুক বাঁধছে দেশটির জনগণ।

এখন প্রশ্ন, বাংলাদেশ কোন পথে হাঁটবে? জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে যাঁরা রাজপথে রক্ত দিয়েছেন, যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েও প্রতিবাদ করতে পিছপা হননি, তাঁরা নতুন একটা দেশের স্বপ্ন দেখেছেন। যেমন দেখেছিলেন ১৯৭১–এর মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা। জনতার সংগ্রামে স্বপ্ন থাকে আকাশছোঁয়া। জুলাইয়ের স্বপ্নও তার ব্যতিক্রম নয়।

কিন্তু অভ্যুত্থানের পরের দিনগুলোতে বাস্তবতা আমাদের স্বপ্নগুলোকে শিকলে বেঁধে ফেলতে চাইছে। মাধ্যাকর্ষণের টানে আমাদের আকাশে উড়তে থাকা স্বপ্নগুলো ঊর্ধ্বমুখী না হয়ে হয়তো নিম্নগামী। পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিবাদী শক্তি হয়তো রাজপথে আর আমাদের উদ্ধত পিস্তল হাতে তাড়া করতে পারছে না, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা আগের চেয়ে অনেক সক্রিয়, সংগঠিত।

যাঁরা জুলাইয়ে একটি দাবিতে একমত হয়েছিলেন, তাঁরা আজ নানা দাবিতে বিভক্ত। কেউ জাতীয়তাবাদী, কেউ সমাজতন্ত্রী, কেউবা ইসলামি রাজনৈতিক অবস্থান থেকে নিজেদের মতাদর্শে বাংলাদেশকে ঢেলে সাজাবার চেষ্টায় ব্যস্ত। সমাজ কেমন হবে, সাংস্কৃতিক আবহ কেমন হবে, তা নিয়ে মতপার্থক্য কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছাপিয়ে বাস্তব জীবনেও প্রভাব ফেলছে।

জুলাইয়ে আমরা ঐকমত্যের যে পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম, সে রকম একতা শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন, গোটা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। একতা যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তারপর কিছুটা হলেও বিভেদ আসবে এটাই স্বাভাবিক। সর্বোচ্চ একতার পরের সময়গুলোতে ঐক্যে কিছুটা শিথিলতা অবশ্যম্ভাবী। ইতিহাস তা–ই বলে। প্রশ্ন হলো, মতবিরোধের এ পর্যায়ে আমরা কতটা যৌক্তিক আচরণ করতে পারি, যাতে কিছু ন্যূনতম প্রশ্নে ঐক্য ধরে রাখা যায়।

বাংলাদেশে এ প্রশ্নগুলো খুব জটিল নয়। আমরা ভোট দেওয়ার অধিকার চাই, বাজারে গেলে জিনিসপত্রের একটা সহনীয় দাম চাই, চাই রাজনৈতিক দলগুলো দেশের প্রশ্নে এক থাকুক, চাই দুর্নীতির ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ, চাই দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়ার ওপর লাগাম টানতে।

এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে জাতীয়তাবাদী, সমাজতন্ত্রী বা ইসলামি রাজনৈতিক অবস্থানের জটিল প্রশ্নগুলোর উত্তর এড়িয়েও একটা ন্যূনতম প্রশ্নে একতাবদ্ধ হওয়া চলে। এটা অনুধাবন করা খুব জরুরি যে জটিল প্রশ্নগুলো নিয়ে বাহাস করতে গিয়ে আশু প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেলে আখেরে লাভ হবে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার। সুদান কিংবা মিসরে যাঁরা বিভেদে জড়িয়েছিলেন, লাভের বখরা তাঁদের কারও ঘরে ওঠেনি। উঠেছে তাঁদের ঘরে, যাঁরা পর্দার আড়ালে থেকে বিভেদের আগুনে ঘি ঢেলেছেন।

তাই এখন বিভেদ পাশে ঠেলে আবারও গুছিয়ে ওঠার সময়। দেশের জন্য আমরা কী চাই, কীভাবে চাই, সে প্রশ্নে মতৈক্য গড়ে তোলার এখনই সময়। কারণ, গণ-অভ্যুত্থান যেমন আমরা সবাই মিলে করেছিলাম, নতুন দেশ গড়ার কাজটাও সবাই মিলেই করতে হবে। আমদের একজনের ব্যর্থতা বাকি সবাইকে ব্যর্থ করে দিতে পারে। তাই ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

  • মানজুর-আল-মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী