২ জুলাই একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক আমাকে দুটি লিংক শেয়ার করে লিখেছেন, আগামীকাল ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু নতুন কারিকুলামে, অথচ ইউটিউবে কালকের ষষ্ঠ-নবম শ্রেণির প্রশ্নপত্র ফাঁস।
ইউটিউবের সেই লিংকগুলোর একটিতে প্রশ্ন আর অপরটিতে উত্তর। এসব দেখার পর বিষয়টি নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্নই ছিলাম। দেখার বিষয় ছিল, পরদিন পরীক্ষায় ঠিক কী আসে। পরীক্ষার পর জানলাম, যা ইউটিউবে ছড়িয়েছিল, তা দিয়েই পরীক্ষা হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রম কেমন হতে যাচ্ছে, এর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে, তা নিয়ে আমাদের ভাবনা পত্রপত্রিকায় লিখেছি। বছরের শুরুতে পাঠ্যপুস্তকের কনটেন্ট কপিপেস্টের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া বিতর্ক বছরের মাঝামাঝিতে এসে ঠেকল ‘মূল্যায়নে’।
‘অঙ্কুরেই’ অস্তিত্বসংকটে পড়া নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর নিয়ে ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা’ উদ্বিগ্ন না হলেও ‘শিক্ষাব্যবস্থার’ এমন একটি যুগের দ্বারপ্রান্তে ঠিক কতটা সুখকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
নতুন শিক্ষাক্রম ‘প্রণেতারা’ ইতিহাসের মুখোমুখি হবেন নাকি বাহবা কুড়াবেন, তা বুঝতে আমাদের আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। তবে ‘এই সময়ে’ যেসব প্রজন্ম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘ডেটাসেটে’ পূর্বতন মূল্যায়নের সাক্ষী হবে, তাদের জন্য খারাপ লাগা থেকে গেল।
একটি শিক্ষাক্রম কতটা ‘অগোছালো’ হতে পারে, তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় দিয়ে দিয়েছে। একটি শিক্ষাক্রমে ঠিক কীভাবে মূল্যায়ন হবে, তা ঠিক করতে লেগে গেল ছয় মাস। পরীক্ষা নেওয়ার ঠিক এক দিন আগে ‘চূড়ান্ত করা হয়েছে মূল্যায়নপদ্ধতি’। কেন এমন হবে?
একটি শিক্ষাক্রমের সত্যিই যদি ‘সূক্ষ্ম পরিকল্পনা’ থাকে, তাহলে পরীক্ষার মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে কেন এত শঙ্কা, কেন এত দ্বিধা? কেন শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার আগের দিন জানাতে হবে যে তারা কীভাবে মূল্যায়িত হবে?
পত্রপত্রিকার প্রকাশিত সংবাদ বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার সামষ্টিক মূল্যায়নে লিখিত ৬৫ শতাংশ এবং হাতে-কলমের কার্যক্রমে ৩৫ শতাংশ। আর এসব পরীক্ষার ফলাফল আসবে সাতটি ইংরেজি বর্ণ অনুযায়ী। (প্রথম আলো, জুলাই ২, ২০২৪)
এই চূড়ান্ত মূল্যায়নপদ্ধতি আদৌও ‘চূড়ান্ত’ কি না, তা সময় বলে দেবে। তবে মূল্যায়নপদ্ধতি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে ‘ধন্দে’ ছিল, তার নমুনা কিছুটা দেওয়া যাক। প্রচলিত গ্রেডিং বা জিপিএ-পদ্ধতিকে উড়িয়ে দিয়ে বিকাশমান ‘নতুন শিক্ষাক্রমে’ অনন্য, অর্জনমুখী, অগ্রগামী, সক্রিয়, অনুসন্ধানী, বিকাশমান ও প্রারম্ভিক—এই সাত স্তর দিয়ে নতুন কাঠামোর খসড়া করা হয়েছিল।
সেখানে বলা হয়েছিল, যদি কোনো শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ স্কেল ‘অনন্য’ পায়, তাহলে বুঝতে হবে, সেই শিক্ষার্থী সব বিষয়ে পারদর্শিতার শীর্ষে আর প্রারম্ভিক স্তর বলতে পারদর্শিতার সর্বশেষ স্তরকে বোঝানো হয়েছিল।
এর আগে ‘ত্রিভুজ’, ‘বৃত্ত’ ও ‘চতুর্ভুজ’ নির্দেশক ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে পিছু হটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় (যুগান্তর, মে ২৫, ২০২৪)।
সবকিছু ছাপিয়ে সর্বশেষ চলতি মাসের শুরুতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজি বর্ণে, যা প্রচলিত গ্রেডিং বা জিপিএতেও ছিল। এই সব বর্ণ দিয়ে কতটা সুখকর ফলাফল আসবে, তা আমি নিশ্চিত নয়। তবে মূল্যায়নপদ্ধতির যে ধাঁচ জাতির সামনে এল, তা নিয়ে আমাদের বাচ্চাদের ‘শিক্ষা’য় নতুন যুগের শুভসূচনা হলো বৈকি।
কয়েক বছর আগে, যখন ‘প্রশ্নপত্র’ ফাঁসের হিড়িক চলছিল, তখন শিক্ষার্থীরা রাত জেগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে প্রশ্নপত্র খুঁজত, উত্তর খুঁজত। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী (তৎকালীন উপমন্ত্রী) এই মন্ত্রণালয়ে আসার পর প্রশ্নপত্র ফাঁসে লাগাম পড়েছিল। কিন্তু কয়েক বছর বিরতির পর শিক্ষাক্রম ও পরীক্ষাপদ্ধতির ধরন পাল্টিয়ে আবার ‘প্রশ্নপত্র’ ফাঁসের গহ্বরে পড়ছে কি না, তা দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর বলছে, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রস্তুত করা মূল্যায়ন নির্দেশিকা বা প্রশ্ন তৈরি করে তা পরীক্ষার আগের দিন প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের কাছে পাঠানো হচ্ছে, যা পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের জন্য ফটোকপি করে সরবরাহ করা হচ্ছে।
আর বাধ সেধেছে, এসব প্রশ্নপত্র প্রেরণের পরপরই তা অনলাইনে চলে আসছে, এরপর উত্তর আসছে। শিক্ষার্থীরা অনলাইন ঘেঁটে ঘেঁটে কিংবা অসাধু শিক্ষকদের সহায়তায় উত্তর জানছে। নৈতিকতার তলানিতে গেলে যে আর কোনো স্তর থাকে না, সেইটা বুঝতে আর আমাদের বাকি নেই।
আমরা যখন পরীক্ষা দিয়েছি, তখন আমরা দেখতাম, পড়া প্রশ্নগুলো কমন পড়ছে কি না। কিন্তু এখন শিক্ষার্থীরা দেখছে, পুরো প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে কমন পড়ছে কি না।
আমি জানি না, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নতুন শিক্ষাক্রমে বাংলাদেশকে ঠিক বিশ্বের দরবারে কীভাবে মেলে ধরবে। তবে পরিকল্পনার হাভাতে থাকা নতুন শিক্ষাক্রমের স্থিতিশীলতা আসবে, নাকি বিতর্কের মধ্যে দিয়ে ‘নতুন বিশ্বের’ নাগরিক তৈরির দায়িত্ব নেবে, তা বুঝতে আমাদের আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।
যদিও শিক্ষামন্ত্রী ও এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) দাবি করছেন, নতুন পদ্ধতিতে প্রশ্নের যে ধরন এবং যেভাবে লিখতে হবে, তাতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও বড় কোনো সমস্যা হবে না। অর্থাৎ তাঁরা মনে করছেন, সৃজনশীল প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা হচ্ছে, যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিয়েই উত্তর দিতে হবে।
তর্কের খাতিরে যদি শিক্ষা কর্তৃপক্ষের এই বক্তব্যকে আমলে নিই, তাহলে এখন প্রশ্ন হলো, এসব প্রশ্নপত্রের ফটোকপিরই-বা প্রয়োজন কেন? পরীক্ষায় শিক্ষকদের গার্ডই থাকতে হবে কেন? প্রশ্নপত্র অনলাইনেই দিয়ে দিন, শিক্ষার্থীরা অনলাইন-অফলাইন ঘেঁটে উত্তর লিখে দেবে।
আর যদি সেটি না হয়, তবে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের’ পক্ষে সাফাই গেয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল রহিতকরণ বড়ই প্রয়োজন। বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে এ ধরনের কথাবার্তা অন্তরায়। আপনারা যদি মনে করেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান অনলাইনে অ্যাকটিভ, ই-মেইল নিয়মিত আদান-প্রদানে দক্ষ, তাহলে তো আর বলার কিছু নেই।
কিন্তু স্কুলগুলো ডিজিটালইজড হয়েছে কি না, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলে ফটোকপির মেশিন আদৌও পৌঁছেছে কি না, কিংবা তারা সেই প্রশ্নপত্র কোথা থেকে পরীক্ষার আগে ফটোকপি করে শিক্ষার্থীদের দেয়—এসব নিশ্চিত না হয়ে ‘সরল মনে’ প্রশ্ন প্রেরণ করে দায়িত্ব শেষ করে দিয়ে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের’ সাফাই গাওয়া একধরনের অপরাধ বটে।
একটা জাতিকে ধ্বংস করতে আর কী লাগে শুনি? আজ যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা হয়তো একদিন ক্ষমতায় থাকবেন না। কিন্তু যে প্রজন্মগুলো তৈরি হচ্ছে, সেই প্রজন্মগুলোকে তো এই জাতি অস্বীকার করতে পারবে না। তারা একসময় দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাবে। অপশিক্ষা গ্রহণের খেসারতে হয়তো দেশ অপশাসন পাবে, তাতে আর সন্দেহ নেই।
আপনারা যদি মনে করেন, প্রশ্নপত্রে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান আয়োজনের আলোচনা সভা আর সাংস্কৃতিক পরিবেশনার প্রতিবেদন থেকে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে শিখবে, তাহলে মনে রাখতে হবে, গ্রামের অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীরা জানেই না, তাদের স্কুল ঠিক কবে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অথবা অনেক স্কুলে এসব কোনো অনুষ্ঠানই হয় না।
কেবল শহুরে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রশ্ন করে গ্রামের ওই সব জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা কীভাবে বাস্তবিক জ্ঞান অর্জন করবে শুনি? যে বিষয়ের সঙ্গে তারা পরিচিতই নয়, তা তাদের কল্পনাশক্তিতে আসবে কীভাবে শুনি? আর তা জানার জন্য কি পাঠ্যপুস্তক মুখস্থ করতে হবে, নাকি এখানেও কার্যক্রমভিত্তিক শিক্ষার উন্মেষ ঘটবে?
আমি জানি না, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নতুন শিক্ষাক্রমে বাংলাদেশকে ঠিক বিশ্বের দরবারে কীভাবে মেলে ধরবে। তবে পরিকল্পনার হাভাতে থাকা নতুন শিক্ষাক্রমের স্থিতিশীলতা আসবে, নাকি বিতর্কের মধ্যে দিয়ে ‘নতুন বিশ্বের’ নাগরিক তৈরির দায়িত্ব নেবে, তা বুঝতে আমাদের আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।
রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়, নাকি উপসর্গ দেখে ওষুধ সেবন করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে, তা নির্ভর করবে ‘সামগ্রিক সেবা’-ব্যবস্থার ওপর। এখন সিদ্ধান্ত সরকারের হাতে থাকুক, তারা আমাদের বাচ্চাদের জন্য কোন ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় বা দেখতে চায়।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই-মেইল: [email protected]