যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন দুই দিনের বেইজিং সফর শেষ করেছেন। তাঁর এ সফরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে ব্লিঙ্কেনের চীন সফরের কথা ছিল। কিন্তু গোয়েন্দা বেলুনকাণ্ডে শেষ মুহূর্তে সফরটি স্থগিত করা হয়। রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাংয়ের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠক ও সোমবার শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন ব্লিঙ্কেন।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষই তাদের বিবৃতিতে ছিন-ব্লিঙ্কেন সংলাপকে অকপট, গভীর ও গঠনমূলক বলে বর্ণনা করেছে।
চীন বলেছে, দুই দেশ উচ্চপর্যায়ের সংলাপের দিকে এগোচ্ছে। ছিন ও ইয়াং যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাবেন। এ ছাড়া যোগাযোগ বাড়াতেও চীন কাজ করবে। চীন বলছে, দুই দেশেই নিজেদের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়াবে এবং মানবিক, শিক্ষা ও একাডেমি পর্যায়ে নিজেদের লোকদের যাতায়াত বাড়াতে উৎসাহিত করবে।
ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠকের সময় ইয়াং চারটি দাবি তুলে ধরেন। এক. যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘চীন থেকে আসা হুমকি তত্ত্ব’ ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। দুই. চীনের বিরুদ্ধে দেওয়া একপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা বাতিল করতে হবে। তিন. চীনের প্রযুক্তিগত বিকাশ রুদ্ধ করার কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। চার. চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন ডিফেন্স টাইমস-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে ইয়াংয়ের চারটি দাবিই নাকচ করে দিয়েছেন ব্লিঙ্কেন।
চীনের বিশ্লেষক ও ভাষ্যকারেরা বলছেন, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা ও তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের অবস্থান খুব তাড়াতাড়ি শিথিল করবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। এ ক্ষেত্রে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নের একমাত্র পথ হচ্ছে বেসরকারি পর্যায়ে বিনিময় ও সংযোগ বাড়ানো।
চীনের আরেকজন বিশ্লেষক ইয়ান ঝো আরেকটি নিবন্ধে লিখেছেন, টেসলা, জেপি মর্গান, মাইক্রোসফটের শীর্ষ নির্বাহীরা সম্পত্তি চীন সফর করেছেন। তাঁদের এ সফর এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক সংঘাতের মাত্রা প্রশমনের ক্ষেত্রে তৈরি করছে।
সফর শেষে ব্লিঙ্কেন সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, দুই পক্ষই চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টাইল জাতীয় রাসায়নিক পণ্য রপ্তানির ব্যাপারে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন দীর্ঘ মেয়াদে কৃষ্ণসাগর খাদ্য চুক্তি করতে সহায়তা করে বিশ্বে খাদ্যসংকটের ঝুঁকি এড়াতে চীন সহযোগিতা করবে।
ব্লিঙ্কেন আরও বলেন, বেইজিং সফরে তিনি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘ঝুঁকিমুক্ত হওয়া’ বলতে যেটা বোঝে, সেটার সঙ্গে ‘একঘরে করে দেওয়া’ বিষয়টির অনেক পার্থক্য রয়েছে।
তিনি বলেন, চীনকে একঘরে করে দেওয়ার কোনো উদ্দেশ্য নেই যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চীনের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার এমন প্রযুক্তি ব্যবহার প্রতিরোধ করবে, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিরুদ্ধে যায়। তিনি চীনের হাইপারসোনিক অস্ত্র উৎপাদন ও চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথাও বলেন।
ব্লিঙ্কেন বলেন, দুই পক্ষই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে আলাপ করেছে। তিনি বলেছেন, চীন রাশিয়ার কাছে মারণাস্ত্র বিক্রি করেছে, এমন কোনো প্রমাণ পায়নি ওয়াশিংটন। কিন্তু চীনের ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানি রাশিয়ার কাছে এমন কোনো পণ্য বিক্রি করছে কিনা যেটা সামরিক উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হয়, সে বিষয়ে বেইজিংকে নজরদারি করতে হবে।
তিনি পুনর্ব্যক্ত করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের স্বাধীনতা সমর্থন করে না, কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায় যে দ্বীপটি নিজেদের রক্ষা করতে পারে। ব্লিঙ্কেন আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরও কর্মকর্তারা সামনে চীন সফরে যাবেন।
গত সেপ্টেম্বর মাসে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে বলেছিলেন, বেইজিংয়ের সঙ্গে নতুন একটা ঠান্ডা যুদ্ধে জড়ানো অথবা চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের অথবা কোনো দেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নেওয়া অথবা চীনের স্বাধীনতায় সমর্থন অথবা চীনের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানোর সুযোগ খুঁজছে না ওয়াশিংটন।
বেইজিং পরবর্তীকালে এগুলোকে ‘পাঁচটি না’ বলে অভিহিত করেছিলেন। বেইজিং পরবর্তীকালে জানিয়েছিল, গত নভেম্বরে বালিতে জি-২০ সম্মেলনের মধ্যে বাইডেন-সি মুখোমুখি বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র এই ‘পাঁচটি না’ আবার উল্লেখ করেছে।
যা-ই হোক, চীনের কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চালু রাখা, তাইওয়ানে অস্ত্র বিক্রি এবং চীনের বিরুদ্ধে আমদানি-রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিতে প্ররোচিত করায়, বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। গত জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আকাশে চীনের গোয়েন্দা বেলুনের আনাগোনা, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারের তাইওয়ান সফরের পর চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে উত্তেজনার পারদ আরও চড়েছিল।
সোমবার ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে সি চিন পিংয়ের বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে সি চিন পিং বলেন, ‘চীনের পক্ষ থেকে আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি এবং বালিতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও আমি যে বোঝাপড়ায় পৌঁছেছিলাম দুই পক্ষ সেটা অনুসরণ করতে সম্মত।
সি চিন পিং বলেন, ‘দুই পক্ষের দিক থেকেই অগ্রগতি আছে এবং কিছু নির্দিষ্ট ইস্যুতে আমরা চুক্তিতে পৌঁছাতে পেরেছি। এটা খুব ভালো। এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের সম্পর্কের ভিত্তি হতে হবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতার ভিত্তিতে। আমি আশা করি, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আমরা আরও ইতিবাচক অবদান রাখতে পারব।’
সি চিন বলেন, প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা আজকের দিনের প্রতিনিধিত্ব করে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সমস্যা অথবা বিশ্ব যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি সেসবের সমাধানে এটা খুব বেশি কিছু দিতে পারে না। সি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে সম্মান করে চীন। যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো অথবা যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক অবস্থান থেকে সরানোর কোনো সুযোগ খুঁজছে না বেইজিং। একই সঙ্গে আমরা আশা করি, যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সম্মান করবে এবং চীনের বৈধ অধিকার ও স্বার্থে তারা কোনো আঘাত হানবে না।
সি চিন পিং বলেন, চীন সব সময় আশা করে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যেন ভালো ও ধারাবাহিক সম্পর্ক থাকে। আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্বের প্রধান দুটি দেশ বাধাবিপত্তিগুলো জয় করতে পারবে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উইন-উইন সহযোগিতার মধ্য দিয়ে একটি সঠিক পথ বের করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যৌক্তিক ও বাস্তববাদী নীতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সি চিন পিং যুক্তরাষ্ট্রকে চীনের মতো একই পথ অনুসরণের কথা বলেন।
গত সোমবার চীনের একজন কলামিস্ট একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘এই বৈঠকের কেবল একটি অর্থ, সেটা হলো দুই পক্ষের মধ্যে মিলিত হওয়া ও আলোচনা অব্যাহত রাখার ইচ্ছা রয়েছে। চীন খুব ভালো করেই জানে তাইওয়ান ইস্যুটি তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এটা স্পষ্ট নয় যে যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই কি চীনকে বুঝতে পারছে কি না?
তিনি লিখেছেন, ছিন-ব্লিঙ্কেন বৈঠকের সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট অর্জন হলো, দুই পক্ষই জনগণ থেকে জনগণ এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিময়ের ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে এই বিনিময় ও বিমান চলাচলের সংখ্যা বাড়লে সেটা রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করবে।
চীনের আরেকজন বিশ্লেষক ইয়ান ঝো আরেকটি নিবন্ধে লিখেছেন, টেসলা, জেপি মর্গান, মাইক্রোসফটের শীর্ষ নির্বাহীরা সম্পত্তি চীন সফর করেছেন। তাঁদের এ সফর এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক সংঘাতের মাত্রা প্রশমনের ক্ষেত্রে তৈরি করছে।
জেফ পাউ এশিয়া টাইমসের চীনবিষয়ক সম্পাদক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত