আজ ২৩ মে ‘আন্তর্জাতিক ফিস্টুলা দিবস’। প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে সহনশীল রেখে মানবসমাজের জীবনযাত্রার চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জাতিসংঘ ২০১৫ সালে টেকসই উন্নয়নের ১৭টি নীতি গ্রহণ করে। টেকসই উন্নয়নের একটি অভীষ্ট লক্ষ্য হলো ‘সব বয়সী সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ’। এই অভীষ্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ সরকার দেশের অন্যান্য সংস্থার টেকনিক্যাল সহায়তায় ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে প্রসবজনিত ফিস্টুলামুক্ত করার একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রসবজনিত ফিস্টুলা হলো মূত্রাশয় অথবা মলদ্বারের মধ্যে একটা ক্ষত বা গর্ত, যাঁর ফলে অনবরত প্রস্রাব বা পায়খানা নির্গত হয়। যদি কোনো কারণে গর্ভবতী মায়েদের বাচ্চা প্রসব বাধাগ্রস্ত হয় অথবা অতিরিক্ত বিলম্ব হয়, তাহলে প্রজনন অঙ্গের বিভিন্ন স্থানে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, পেশি নষ্ট হয়ে যায় এবং অনেক সময় পেশি পচে যায়।
পচনযুক্ত সেসব পেশিই বাচ্চা প্রসবের পাঁচ-সাত দিন পরে খসে পড়ে এবং সেখানে ছিদ্র সৃষ্টি হয়। এর ফলে তখন প্রস্রাবের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে পায়খানার ওপরও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে প্রসবজনিত ফিস্টুলা বলে।
ফিস্টুলা একটি অত্যন্ত শারীরিকভাবে বেদনাদায়ক ও মানসিকভাবে ক্ষতিকর ব্যাধি। ফিস্টুলায় আক্রান্ত হওয়ার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে। অনবরত মূত্র অথবা মল ঝরার কারণে শরীর থেকে সারাক্ষণ দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। ফিস্টুলায় আক্রান্ত মায়েরা শারীরিকভাবে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে প্রায় অক্ষম। দীর্ঘদিন ফিস্টুলা আক্রান্ত মায়েরা প্রজনন অঙ্গে সার্বক্ষণিক প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন এবং স্নায়ুজনিত দুর্বলতার কারণে অনেক সময় চলাফেরা কষ্টকর হয়।
গ্রামীণ জনপদের যেখানে স্বাস্থ্যসচেতনতা কম, সেখানে প্রসবজনিত ফিস্টুলা সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় এটাকে একধরনের নিয়তির অভিশাপ মনে করা হয়। সাধারণত স্বামীরা তাঁদের পরিত্যাগ করেন। অনেক সময় বাবা–মা বা অন্য নিকটাত্মীয়দের কাছেও আশ্রয় পান না। সমাজের প্রতিটি স্তরেই তাঁরা নিগৃহীত হন। একজন ফিস্টুলা রোগীর যে ধরনের মানসিক বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং অশান্তি অনুভব করেন, সেটা খুবই ভয়াবহ।
প্রসবজনিত ফিস্টুলার প্রকোপ ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিম দেশগুলোতে অনেক ছিল, তবে উন্নত মানের প্রসূতিসেবার কারণে এটি উন্নত বিশ্বে প্রায় আজকাল দেখা যায় না। উন্নয়নশীল দেশে যেখানে মাতৃস্বাস্থ্য পিছিয়ে রয়েছে, সেখানে প্রসবজনিত ফিস্টুলা দেখা যায়। এই নারীরা প্রায়ই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর, যারা গ্রামীণ অঞ্চলে বসবাস করেন এবং যাঁদের ভালো স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। আর্থিক অসুবিধা, ভালো যোগাযোগব্যবস্থার অভাব, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ইত্যাদি কারণে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করার অন্তরায় হয়ে থাকে।
প্রায়ই তাঁদের গর্ভধারণ এবং বাচ্চা প্রসবের জন্য গ্রামীণ দাই অথবা পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নেওয়া হয়। এঁদের অনেকেই কোনো প্রসবকালীন সেবা পান না। তাই তাঁদের গর্ভস্থ শিশুর আকার, অবস্থান এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি সম্পর্কে কোনো পূর্ববর্তী ধারণা না থাকায় ডেলিভারি যে বাধাগ্রস্ত হতে পারে বা সিজারিয়ানের প্রয়োজন হতে পারে, এ ব্যাপারে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় না।
বাংলাদেশ মাতৃস্বাস্থ্যে অসাধারণ অগ্রগতি সাধন করেছে এবং এই কৃতিত্বের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এখন সরকারি, বেসরকারি সংস্থাসহ সবার সহযোগিতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের সব ফিস্টুলা রোগীকে চিকিৎসার আওতায় এনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ফিস্টুলামুক্ত করা সময়ের দাবি।
বাংলাদেশে প্রকৃত পরিমাণ ফিস্টুলা রোগীর সংখ্যা জানা নেই, তবে ২০১৬ সালের এক সমীক্ষায় অনুমান করা হয়, দেশে প্রায় ১৯ হাজার ৭৫৫ ফিস্টুলা আক্রান্ত নারী আছেন এবং প্রতিবছর প্রায় ১০০০-১২০০ নারী নতুনভাবে প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন। পাশাপাশি প্রতিবছর প্রায় ৭০০ প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত মা সার্জারির সুযোগ পাচ্ছেন। এ ধরনের ফিস্টুলা আক্রান্ত নারীদের অনেকেই কয়েক দশক ধরে এই সমস্যায় ভুগছেন। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০ লাখ নারী প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত।
যদি ফিস্টুলা হওয়ার স্বল্প সময়ের মধ্যে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়া যায়, তখন বিনা সার্জারিতে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এবং মূত্রথলিতে কয়েক সপ্তাহ ক্যাথেটার দেওয়ার মাধ্যমে ভালো করা সম্ভব। কিন্তু যাঁদের ফিস্টুলা দীর্ঘ সময় ধরে আছে, তাঁদের চিকিৎসা অপারেশন ছাড়া একেবারেই অসম্ভব। ফিস্টুলা অপারেশন জটিল এবং একমাত্র দক্ষ সার্জনরাই এই অপারেশন করতে পারেন। বাংলাদেশে মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন চিকিৎসক আছেন, যাঁরা ফিস্টুলা অপারেশনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং দক্ষ।
দেশে হোপ হাসপাতাল, ল্যাম্ব হসপিটাল, ম্যামস ইনস্টিটিউট, কুমুদিনী হসপিটাল, আদদ্বীন হসপিটাল, বিএসএমএমইউসহ ১৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফিস্টুলা চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। ফিস্টুলা সার্জারি অনেক ব্যয়বহুল, যা গরিব রোগীদের জন্য বহন করা অসম্ভব। হোপ হাসপাতালসহ দেশের অন্য হাসপাতালগুলো সরকার ও দাতা সংস্থার সহযোগিতায় ফিস্টুলা অপারেশন বিনা মূল্যে করে থাকে।
ফিস্টুলা অপারেশন করে ভুক্তভোগী মায়েদের সুস্থ করার পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই প্রতিরোধের দিকেও নজর দিতে হবে। এই লক্ষ্যে মানসম্মত মাতৃত্ব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে সর্বজনীনভাবে। সব মায়ের জন্য একজন দক্ষ মিডওয়াইফ দিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সবাই গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসব এবং প্রসবোত্তর সেবা পান। বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ মিডওয়াইফ প্রশিক্ষিত করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাঁদের কাজের ব্যবস্থা করলেই একমাত্র সর্বজনীন মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
বাংলাদেশ মাতৃস্বাস্থ্যে অসাধারণ অগ্রগতি সাধন করেছে এবং এই কৃতিত্বের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। এখন সরকারি, বেসরকারি সংস্থাসহ সবার সহযোগিতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের সব ফিস্টুলা রোগীকে চিকিৎসার আওতায় এনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ফিস্টুলামুক্ত করা সময়ের দাবি।
ফিস্টুলা বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশকে ফিস্টুলামুক্ত করতে হলে দেশের মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থার কারিকুলামে ফিস্টুলাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং দেশে ফিস্টুলা চিকিৎসার বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা আবশ্যক।
ইফতিখার মাহমুদ, অধ্যাপক, কলেজ অব পাবলিক হেলথ, ইউনিভার্সিটি অব নাব্রাস্কা, যুক্তরাষ্ট্র