হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনে কেউ গেলেই দেখতে পাবেন এক থেকে তিনতলা অবধি লম্বা টানা বারান্দা। সারি সারি কোর্ট রুম চারপাশে। বারান্দায় কালো কোট গাউন পরা ব্যস্ত আইনজীবীদের এক কোর্ট থেকে অন্য কোর্টে ছুটে চলা। এর মধ্যেই কিছু কিছু কোর্ট-রুমের বাইরে বারান্দায় সপ্তাহের বিশেষ বিশেষ দিনে অতিরিক্ত মানুষের ভিড় জমে। তাঁদের অধিকাংশেরই পরনে ময়লা-মলিন জামা, চোখে অসহায় দৃষ্টি, মুখে হতাশার ছাপ। চারপাশে কী ঘটছে, তা-ও যে ভালো বুঝতে পারছেন, তেমন মনে হয় না তাঁদের দেখে। কেমন যেন জবুথবু ভাব, ভয় আর দুশ্চিন্তার মিশেল। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে জটলা পাকিয়ে বসে আছেন প্রায় বারান্দাজুড়ে। কেউ কেউ আবার সঙ্গে করে চিড়া-মুড়ি ধরনের শুকনা খাবার এনেছেন দুপুরে খাবেন বলে।
৫০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রির টাকায় উকিলের ফি পরিশোধের পর ১০০ টাকা প্লেটের ভাত-তরকারি দুপুরে খাওয়া তাঁদের জন্য একরকম বিলাসিতাই। দারিদ্র্য আর অসহায়ত্ব যেন মিলেমিশে গেছে তাঁদের মুখগুলোতে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কান খাড়া সবার, যাতে কোর্টের ভেতর থেকে মামলা নম্বর আর নাম ধরে ডাক আসামাত্র দৌড়ে যাওয়া যায়। তাঁরা সবাই এসেছেন জামিনের জন্য। তাঁদের গাদাগাদি ভিড়ে খোলা বারান্দাতেও ভারী গুমোট পরিবেশ।
হাইকোর্টের ধবধবে সাদা দেয়ালেও পানের পিকের দাগ, ময়লার ছোপ। ভেতরে-ভেতরে নিজেদের ভিন্ন ভাবা নাক উঁচু উকিলবাবুরা প্রায়ই তাই এড়িয়ে চলেন আগাম জামিন দেওয়া কোর্টের সামনের ওই বারান্দাগুলো।
কিন্তু ওই বারান্দাতেই সপ্তাহের বিশেষ দিনগুলোতে আগাম জামিনের আশায় এসে ভিড় করেন জিন্দার ফকির, তারা মিয়া, ইউসুফ আলী কিংবা আবু বকর মোল্লার মতো মানুষেরা। পরিচিত লাগছে কি নামগুলো? যদিও এঁদের কথা মনে রাখার দায় পড়েনি কারও। তবু মানুষগুলোর কথা আবার নতুন করে মনে পড়ল, ১৪ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোতে প্রকাশিত দুটি খবর দেখে।
একটির শিরোনাম ছিল ‘একটি মামলায় বিএনপি নেতাদের যেভাবে আসামি করল পুলিশ’ আর অন্যটি ‘বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা, অসুস্থ, প্রবীণ, প্রবাসীরাও আসামি’। প্রথম খবরটিতে বলা হচ্ছে, ছেলেকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন এক বাবা। পুলিশ যখন জানল তাঁর ছেলে ছাত্রদলের নেতা, তখন মামলা নিতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানায়। পরে পুলিশ তাঁকে দেড় ঘণ্টা অপেক্ষায় রেখে একটি এজাহার (মামলার বিবরণ) লিখে নিয়ে আসে। তিনি সেই এজাহার পড়ে দেখেন, তাঁর ছেলে বিএনপির যে নেতার অনুসারী, সেই নেতার নাম লেখা হয়েছে এক নম্বর আসামি হিসেবে।
অন্য আসামিরাও বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা।’ অথচ আহত ছাত্রদল নেতা পরিষ্কার বলেছেন আসামিদের কেউ ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। তাই পুলিশের তৈরি এজাহারে স্বাক্ষর করেননি অভিযোগকারীরা। কিন্তু তাতে থেমে থাকেনি মামলা, বিএনপি নেতাদের আসামি করেই মামলা করে দিয়েছে পুলিশ।
দ্বিতীয় খবরটি আরও চমকপ্রদ। ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিএনপির এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ৩১ জুলাই ভোলার ঘটনা থেকে শুরু করে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনায় দলের তিন কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি নেতা-কর্মী।
এসব ঘটনায় ২০০ জনের বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। চার হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে। এ ছাড়া বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা হয়েছে বহু জায়গায়, জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা, বিএনপি নেতাদের বাড়ি, গাড়ি ও কার্যালয়ও রক্ষা পায়নি এই হামলা থেকে। হামলা করেছেন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা, তাঁদের সহায়তা করেছে পুলিশ; কিন্তু উল্টো মামলা হয়েছে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেই।
১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ৪৬। এর মধ্যে ২৯টির বাদী পুলিশ। ১৭টি মামলা করেন সরকারি দলের নেতারা। এই মামলা খাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অসুস্থ, প্রবীণ ও প্রবাসে থাকা ব্যক্তিরাও আছেন। আছেন পঙ্গু, মৃত কিংবা ঘটনার সময় দেশের বাইরে থাকা ব্যক্তি।
গত কয়েক বছরের চর্চা হলো নির্বাচন এলেই এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। একটির পর একটি মামলা দিতে থাকে পুলিশ। চাই ঘটনা ঘটুক বা না-ই ঘটুক, অভিযুক্ত ব্যক্তি জড়িত থাক বা না-ই থাক। যেমন ঘটেছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে আগে। ‘এক ভয়ংকর সেপ্টেম্বর’! ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রথম আলোর শিরোনাম ছিল এটি। নির্বাচন সামনে নিয়ে সরকারি দল যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ হতে পারে এই খবর। নির্বাচন মানে এ দেশে বাঁচা-মরার লড়াই। আর লড়াইটা যেহেতু বাঁচা-মরার, তাই যেকোনো উপায়ে জিততে ন্যূনতম কোনো দ্বিধা নেই কারও।
গত কয়েক বছরে বিরোধী দলকে দমনের জন্য যে অস্ত্রগুলো নির্বিচার ব্যবহৃত হয়েছে গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দায়ের, ভয়ভীতি দেখিয়ে এলাকা ছাড়া করা তার মধ্যে অন্যতম। তবে সবচেয়ে বেশি সম্ভবত ব্যবহৃত হয়েছে ‘মামলা’। এই মামলাকে কেউ বলে গায়েবি মামলা, কারও মতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা। নাম যা-ই দেওয়া হোক, এগুলো আসলে মিথ্যা মামলা।
ঘটনাই ঘটেনি, কিন্তু মামলা হয়েছে; ব্যক্তি উপস্থিত ছিল না, কিন্তু আসামি হয়েছে; সাক্ষী কিছুই জানেন না, কিন্তু তাকে সাক্ষ্য দিতে তলব করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রতিটি মামলায় যদি ১০ জন থাকে নামধারী আসামি, তবে অজ্ঞাতনামা আসামি হয়েছে কয়েক শ। আমার সুযোগ হয়েছিল এ ধরনের কিছু মামলার এজাহার দেখা।
শুধু আসামিদের নাম, ঠিকানা, তারিখ আর ঘটনাস্থল পরিবর্তন করে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন পর্যন্ত অপরিবর্তিত রেখে অভিন্ন বাক্যে লেখা একেকটি এজাহার।
একটা নির্বাচনকে ঘিরে সরকারি দল তার বিরোধীদের ওপর নানামুখী দমন-পীড়নের সঙ্গে সঙ্গে মামলাকে কী করে ব্যবহার করতে পারে, তার ক্ল্যাসিক উদাহরণ হলো ২০১৮ সালে বিরোধী দলকে দমনের জন্য সরকারের দায়ের করা মামলার খেলা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর মাসে নাশকতার মামলা হয়েছে যথাক্রমে ৫৭৮, ৭৬ ও ৪৩টি।
এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াত ও এর অঙ্গসংগঠনের ১ হাজার ৫০৯ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করেছে পুলিশ। প্রায় সব মামলার বাদী পুলিশ। এসব মামলার তথ্য বলছে, পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে ৯০ বার। ওই মাসে উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ১৮৬টি ককটেল ও ৩৭০টি পেট্রলবোমা। পুলিশের ওপর এমন হামলা এবং ককটেল-পেট্রলবোমা উদ্ধারের এই সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। যে বছরগুলোতে শহরময় জ্বালাও-পোড়াও আর সংঘাত ছিল, তখনো পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে এর অর্ধেক মামলাও হয়নি। যদিও পত্রিকার খবর বলছে সরেজমিনে ঘুরে ককটেল বিস্ফোরণ, জমায়েত বা নাশকতার কোনো তথ্য পায়নি তারা।
সব এলাকার বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের তালিকা পুলিশের হাতেই আছে। ১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের তৈরি করা নাগরিক তথ্যভান্ডারে (সিআইএমএস) নাম ধরে খুঁজলে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় চলে আসে। এসব ব্যবহার করেই মামলাগুলো করে পুলিশ।
সব এলাকার বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের তালিকা পুলিশের হাতেই আছে। ১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে পুলিশের তৈরি করা নাগরিক তথ্যভান্ডারে (সিআইএমএস) নাম ধরে খুঁজলে তাঁদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় চলে আসে। এসব ব্যবহার করেই মামলাগুলো করে পুলিশ।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও মামলা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। ঘটনা না ঘটলেও মামলা হচ্ছে, এই কল্পিত ঘটনার উৎস কী, জানতে চাইলে পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে সে সময় বলেন, পুরোনো রাজনৈতিক সংঘাতের মামলাগুলোর ওপর নাম, তারিখ ও ঘটনাস্থল বদলে নতুন মামলাগুলো করা হচ্ছে। অনেকটা অনিচ্ছায় তাঁদের এ কাজ করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ঊর্ধ্বতনদের নির্দেশেই মামলা হচ্ছে।
এ ধরনের গায়েবি মামলায় জামিন যাঁরা নিতে আসেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন পঙ্গু, বয়োবৃদ্ধ, নানান রোগে আক্রান্ত অসুস্থ ব্যক্তি। অধিকাংশই বিএনপির নেতা-কর্মী হলেও আসামির তালিকায় আছেন খুব সাধারণ কৃষক, দিনমজুর, কৃষিশ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শ্রেণির লোকজনও। ‘দিন আনি দিন খাই’ এই মানুষগুলো যখন মামলায় পড়ে, তখন সর্বস্ব হারায় তারা।
দেশের নানা প্রান্ত থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ার খরচ, ঢাকায় থাকা-খাওয়ার খরচ, উকিলের ফি, মামলা চালানোর খরচ—সব মিলিয়ে নাভিশ্বাস অবস্থা। আর জামিন তো মামলার ইতি নয়, বরং শুরু। অভিযোগপত্রে নাম এলে এই মামলা কত দিনে শেষ হবে, কেউ জানে না। অথচ দরিদ্র এই মানুষগুলোর বেশির ভাগই মিথ্যা মামলার শিকার। তা ছাড়া মামলায় নাম থাক বা না থাক, দলীয় পরিচয়ের কারণে এলাকায় থাকতে পারেন না, এমন মানুষের সংখ্যা অসংখ্য। কারণ অজ্ঞাতনামা হয়ে যেকোনো মামলায় ঢুকে যাওয়া মুহূর্তের ব্যাপার মাত্র।
আবারও আসছে আর একটি নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৫ মাস বাকি থাকতেই পুলিশের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। একদিকে সরকারি দল বহুদিন ধরেই বলে আসছে বিএনপির আন্দোলনের সক্ষমতা নেই, অন্যদিকে নির্বাহী বিভাগের প্রধানের পুনঃ পুন আশ্বাস সত্ত্বেও বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশের গুলি, টিয়ার গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট আর প্রশাসনসহ যুবলীগ, ছাত্রলীগের বাধা। এই বাধায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছেন, আহত হচ্ছেন বিএনপির কর্মী আবার মামলাও হচ্ছে তাঁদের নামেই।
নির্বাচন কমিশন বা সরকার মুখে যতই বলুক সামনের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, মাঠের চিত্র কিন্তু ভিন্ন। এই চিত্র বলে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় থাকাই সরকারের শেষ কথা আর তার জন্য যা কিছু দরকার, তাই করতে প্রস্তুত সরকার।
বলা বাহুল্য, নির্বাচন কমিশন বা সরকার মুখে যতই বলুক সামনের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, মাঠের চিত্র কিন্তু একেবারেই ভিন্ন। এই চিত্র বলে যেনতেন ভাবে ক্ষমতায় থাকাই সরকারের শেষ কথা আর তার জন্য যা কিছু দরকার তাই করতে প্রস্তুত তারা।
রুমিন ফারহানা বিএনপির সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী