একটা গণ–আন্দোলন সফল হওয়ার পর গত বছরের আগস্ট মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব পায়; দেশের কোটি কোটি মানুষের প্রত্যাশার কোনো অন্ত ছিল না। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর বিগত স্বৈরচারী শাসকের অধীনে থাকতে থাকতে মানুষ অনেকটা ভুলতেই বসেছিল রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক জীবনে চাওয়া-পাওয়া অথবা প্রত্যাশার জায়গা বলেও কিছু একটা আছে।
মানুষের ওপর যা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এক অর্থে সাধারণ নাগরিকদের সেটা মেনে নিতে হয়েছে। হঠাৎ এক রাতের মধ্যে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়া কিংবা বেগুনের ঊর্ধ্ব মূল্য এসব আমরা দেখেছি।
রোজার সময় তৎকালীন স্বৈরশাসক শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা গেছে, বেগুনের দাম বেড়ে যাওয়ায় যারা ইফতারে মুখরোচক খাবার তৈরি করতে পারছেন না, তাঁরা বিকল্প সবজি হিসেবে মিষ্টিকুমড়া দিয়ে বেগুনি বানাতে পারেন।
মাংসের দাম বেড়ে গেলে কাঁঠাল দিয়ে বার্গার বানানোর রেসিপি দেওয়ার গল্পও আমরা শুনেছি। সেই বার্গার খেতে নাকি মাংসের মতোই! জনগণকে নিয়ে এভাবেই ঠাট্টা করতে দেখা গেছে বিগত আমলের মন্ত্রী-এমপিদের।
কোথায় তাঁদের উচিত ছিল দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা কিংবা না পারলে অক্ষমতা প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়া। সেটা না করে এসব দাম্ভিক কথা বলে বেড়াতে দেখা গেছে নিয়মিত। এর একটা অন্যতম কারণ হয়তো ছিল ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট। তাঁরা যখন ইচ্ছা নিজেদের মতো করে দাম বাড়িয়ে দিতে পারতেন। সরকারের কারও হয়তো কিছু বলার ছিল না। কারণ, তাঁরা নিজেরাও হয়তো সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের সব খাতের মানুষ একের পর এক নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হতে থাকেন। নানা রকম আন্দোলন আমরা দেখেছি। হয়তো দীর্ঘদিনের জমে থাক ক্ষোভ ও বলতে না পারার জায়গা থেকেই এসব আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। কেউ হয়তো তাঁদের কথা শুনতে চায়নি। তাই এবার যখন সুযোগ পেয়েছে, সবাই নিজেদের দুঃখ-কষ্টের কথা হয়তো সরকারকে জানাতে চেয়েছে।
সব মিলিয়ে বলতেই হচ্ছে, এ বছর রোজার ঈদ বিগত আমলের চেয়ে অনেক স্বস্তিদায়ক ছিল নাগরিকদের জন্য। ভবিষ্যতে নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তাদের উচিত হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে অন্তত এবারের ঈদ আয়জনের পুরো ব্যাপারটা সরকার কীভাবে সামলেছে, সে বিষয়ে ছবক নেওয়া। যাতে এমন ঈদ এই বাংলার মাটিতে বারবার ফিরে ফিরে আসে।
একের পর এক আন্দোলন হলেও সরকারকে খুব একটা হার্ডলাইনে যেতে দেখা যায়নি; বরং সরকার ধৈর্যের সঙ্গেই সব পক্ষের কথা শোনার চেষ্টা করেছে। অনেক ক্ষেত্রে হয়তো দাবিগুলো সরকার মেনে নিতে পারেনি। কারণ, সরকারেরও সীমাবদ্ধতা আছে। সে ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, সরকার নিজেদের অক্ষমতার কথা প্রকাশও করেছে।
অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর অনুপস্থিতি এবং পরবর্তী সময় তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এর মধ্যে যখন এ বছর পবিত্র রমজান মাস এল। সবাই শঙ্কায় ছিল, আবার কি তাহলে দ্রব্যের দাম বাড়বে?
কারণ, বিগত এক দশকে এটা ছিল খুব স্বাভাবিক বিষয়। রোজা এলেই এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিতেন। মানুষকে এসব দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যেতে হয়েছে।
এ বছর যখন সবাই শঙ্কায় ছিল, ঠিক তখনই আমরা আবিষ্কার করলাম, বেশির ভাগ পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে ছিল। খুব একটা দাম বাড়তে দেখা যায়নি।
ঈদের সময় প্রতিবছর বাড়ি ফেরার অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভোগান্তি। সড়কপথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম। ট্রেনগুলো ঠিক সময়ে ছাড়ত না। নিরাপত্তা শঙ্কা তো ছিলই। এ বছর যখন পুলিশের মনোবল এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি, তখন শঙ্কাটা আরও বেশি ছিল।
অথচ আমরা দেখলাম এর ঠিক উল্টো চিত্র। তেমন কাউকে বাড়ি ফিরতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়নি। ট্রেনগুলো ঠিক সময়ে ছেড়ে গিয়েছে। সড়কপথে জ্যাম দেখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক।
উল্টো এ বছর দুটি চমৎকার আয়োজনও আমরা দেখতে পেয়েছি। ঈদের আগের দিন, চাঁদরাতে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মেহেদি উৎসবের আয়োজন দেখেছি। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তরের প্রশাসকের উদ্যোগের চমৎকার একটি ঈদ আয়োজন চোখে পড়েছে।
ঈদ–আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার এই উদ্যোগগুলো হয়তো ভবিষ্যতে আরও চমৎকারভাবে করা যাবে।
তবে এখানে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, ঢাকা শহর ঈদের সময় প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। সেই ফাঁকা শহরে ঈদের দিন ঢাকা উত্তরের প্রশাসক ও সিটি করপোরেশন মিলে এমন একটা আয়োজন যে সফলভাবে করতে পেরেছে, এটি বেশ লক্ষণীয়।
যেখানে হয়তো অনেকেই নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিল, সেখানে দেখা গেল মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে। আয়োজনও কোনো রকম বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শেষ করা গিয়েছে।
সব মিলিয়ে বলতেই হচ্ছে, এ বছর রোজার ঈদ বিগত আমলের চেয়ে অনেক স্বস্তিদায়ক ছিল নাগরিকদের জন্য। ভবিষ্যতে নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তাদের উচিত হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে অন্তত এবারের ঈদ আয়জনের পুরো ব্যাপারটা সরকার কীভাবে সামলেছে, সে বিষয়ে ছবক নেওয়া। যাতে এমন ঈদ এই বাংলার মাটিতে বারবার ফিরে ফিরে আসে।
আমিনুল ইসলাম জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
