এই কমিশনকে ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন’ বলে ডাকা হচ্ছে। তবে কমিশনের কাজের বড় অংশজুড়ে থাকবে সংবাদমাধ্যম। এই কমিশনের প্রথম বৈঠক সম্পন্ন হয়েছে। যত তাড়াতাড়ি এই কমিশন সব দিক আলোচনা করে তাদের পরামর্শগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে দিতে পারবেন, সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিক, কর্মী এবং দেশের জন্য ততই ভালো। সংবাদমাধ্যমের বর্তমান অবস্থা, মানুষের জীবনে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা এবং সাংবাদিকদের নিজেদের পেশাগত জীবন এখন গভীর চিন্তা ও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
খবরের কাগজ, টেলিভিশন চ্যানেল এবং অনলাইন পোর্টালের সংখ্যা এখন অনেক। তাদের টেকসইতা, গুণমান ও সংবাদমাধ্যমের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে অনেক প্রশ্ন সংবাদের ভোক্তাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এই কমিশনের কাছে সংবাদের ভোক্তা হিসেবে ও সংবাদমাধ্যমের একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে কয়েকটা দিক তুলে ধরা প্রয়োজন।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের ৫ শতাধিক পত্রিকা, ৩৫টি টিভি চ্যানেল এবং অগণিত অনলাইন নিউজ সাইটের প্রয়োজন আছে কি না? যে যেমন ভাবে পারছেন খবরের প্রতিষ্ঠান খুলছেন। সংবাদমাধ্যমের এমন বিস্তার কেমন যেন এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করেছে। এই প্রবণতার মধ্যে শৃঙ্খলা প্রয়োজন আছে কি না, তা এই কমিশনের ভেবে দেখা প্রয়োজন।
সংবাদমাধ্যমকে মনে করা হয় তথ্য সরবরাহের এক অন্যতম মাধ্যম। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখার জন্য এ এক প্রতিরক্ষাব্যূহ। কিন্তু বর্তমানে তা যেন কিছু ধনী ব্যবসায়ীর খেলায় পরিণত হয়েছে। অনেক সাংবাদিকও মনে করছেন, একটা সংবাদ প্রতিষ্ঠান খুলে বসলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কিছু আয় করা সম্ভব।
কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক সংবাদ প্রতিষ্ঠানের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, টেকসই ব্যবসায়িক মডেলের অভাব। সংবাদমাধ্যমের প্রধান আয়ের উৎস হলো বিজ্ঞাপন। কিন্তু বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের বাজার অনেক সীমিত। যাঁরা বিজ্ঞাপন দেন, তাঁদের বছরের মোট বাজেট যদি ১০০ কোটি টাকা হয়, তাহলে ৫০০ পত্রিকা, ৩৫টা চ্যানেল এবং অসংখ্য অনলাইন পোর্টাল সেই বাজেট থেকে কী আয় করতে পারবে? এমন বাজারে নিজেদের টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব।
যে ব্যবসাগুলো তাদের পণ্যের প্রচার করে, তাদের পক্ষে প্রতিটি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের জন্য বিজ্ঞাপনী বাজেট রাখা দুষ্কর। এর ফলে, সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো নানা রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, অনেক ক্ষেত্রে তাদের কর্মীদের বেতন দিতেও ব্যর্থ হয়।
এমন বাজার পরিস্থিতি সুস্থ নয়, টেকসই নয়। যদি আমরা সংবাদমাধ্যম সংস্কার নিয়ে সত্যিই আন্তরিক হই, তবে সংবাদ প্রতিষ্ঠানের এই অপ্রতিরোধ্য বিস্তার বন্ধে কিছু একটা করতে হবে। কমিশনকে এটা পরিষ্কারভাবে বলা দরকার, যেকোনো ইচ্ছুক ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীকে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল বা অনলাইন পোর্টাল চালানোর অনুমতি দেওয়া কতটা উচিত? বড় বড় ঋণখেলাপিও সংবাদপত্রের মালিক হয়েছেন।
এই সম্প্রসারণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের ওপর। আমাদের সাংবাদিকদের জীবনমান কেমন? একজন সাংবাদিক কয় টাকা বেতন পান? যা পান, তা কী অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতের তুলনায় যথাযথ? বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা নিতান্ত অসচ্ছল জীবন যাপন করেন।
সংবাদমাধ্যম খাতে ওয়েজবোর্ড বলে একটা মজুরিবোর্ড রয়েছে। কিন্তু কয়টা প্রতিষ্ঠান তা মেনে চলে? সংবাদমাধ্যম খাতের মানবসম্পদ ছাঁটাই–সংক্রান্ত খবর কোথাও প্রকাশিত হয় না। অন্যান্য খাতের কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ পায়। কিন্তু সংবাদমাধ্যম নিজেদের কর্মীদের ছাঁটাইয়ের খবর প্রকাশ করে না বা করতে পারে না। এই নীরবতা দ্বিমুখী ও ক্ষতিকর।
সংবাদমাধ্যম খাতের বিনিয়োগকারীরা সংবাদ ব্যবসা বুঝেও বোঝেন না। রাতারাতি টাকা বানিয়ে ফেলার ব্যবসা এটা নয়। সংবাদমাধ্যম দীর্ঘমেয়াদি সংকল্প, ধৈর্য ও দায়িত্ববোধ থাকলেই এই বিনিয়োগ সফল হয়। তাই এই খাতে বিনিয়োগের আগে পুনর্বিবেচনা করা উচিত। সাংবাদিক ও অন্য কর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার সময় বিনিয়োগকারীদের নিশ্চিত করতে হবে, তাদের বেতন-ভাতা নিয়মিত ও সময়মতো পরিশোধ করা হবে। সংবাদ প্রতিষ্ঠান কোনো বিলাসিতা বা শখ প্রকল্প নয়। যাঁরা এই খাতে বিনিয়োগ করেন বা করবেন, তাঁদের বুঝতে হবে যে তাঁরা একটি গুরুতর দায়িত্ব নিচ্ছেন।
সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হোক, আমরা চাই না। সরকার, বেসরকারি খাত, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সাংবাদিকদের কাজে বা নীতিতে হস্তক্ষেপ করা কেমন করে বন্ধ করা যায়, তা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। দুঃখজনকভাবে আমরা এমন এক সংস্কৃতি দেখেছি, যা সাংবাদিকদের সরাসরি বা পরোক্ষভাবে চাপের মুখে পড়তে বাধ্য করা হয় এবং তারা সেলফ-সেন্সরশিপ আরোপে বাধ্য হন। এমন পরিস্থিতি সংবাদমাধ্যমের ওপর জন আস্থাকে দুর্বল করে সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ন করে।
সাংবাদিকদের কী লেখা উচিত এবং কী উচিত নয়, তা নির্ধারণ করবেন পেশাদার সাংবাদিক নিজে এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান। এমন মুক্ত সংবাদমাধ্যম একটা স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকতার এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা সংবাদমাধ্যম সংস্কার কমিশনের একটা প্রধান দায়িত্ব। সংবাদমাধ্যমের অপর অংশ সংবাদের ভোক্তাদের মতামত কমিশনের বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের পেশাগত উন্নয়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। প্রতিটা সংবাদ প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালাতে সক্ষম মানবসম্পদ বিভাগ থাকা প্রয়োজন। যদি কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অর্থ ব্যয় করতে না পারে, তবে তাদের সংবাদের বাজারে থাকার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
প্রশিক্ষণ শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা ঠিক নয়। ব্যবসা, রাজনীতি, সংস্কৃতি, বিনোদনসহ বিভিন্ন খাতের বিষয় সম্পর্কে সাংবাদিকদের জ্ঞান থাকা জরুরি। সাংবাদিকদের বিভিন্ন পেশাদার সমিতি ও সংগঠন আছে। তারাও নানা রকমের কর্মশালা ও সেমিনারের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা এবং জ্ঞানের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে।
ইকরাম কবীর- গল্পকার। [email protected] <mailto:[email protected]>