গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে, করোনা মহামারির পর থেকে সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা-ব্যবস্থায় এক বিশাল পরিবর্তন এসেছে। কোভিড মোকাবিলা করতে গিয়ে এ সময় লোকজনকে মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে হয়েছে। এমনকি অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও খুব প্রয়োজন না হলে হাসপাতালে যাননি রোগীরা। চিকিৎসকেরাও হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন না থাকলে রোগীকে নিরুৎসাহিত করেছেন হাসপাতালে আসতে। চিকিৎসা দিয়েছেন অনলাইনে, মুঠোফোনে, ল্যাপটপের সামনে বসে। অনলাইনে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার বিষয়টি আরও সহজ হয়ে উঠেছে প্রযুক্তির বিকাশের কারণেও। এরই মধ্যে মুঠোফোনেও হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, জুম ইত্যাদিসহ এমন সব অ্যাপস যুক্ত হয়েছে, যার মাধ্যমে চিকিৎসকেরা রোগীদের সেবা দিতে পারছেন যার যার অবস্থানে বসেই।
এমন অনেক সহজলভ্য ও হ্যান্ডি (হ্যান্ড-হেল্ড) ডিভাইসও এখন পাওয়া যায়, যার মাধ্যমে ইসিজি-ইকোসহ রক্তেরও বেশ কিছু দরকারি টেস্ট দ্রুততম সময়ে এবং প্রায় নির্ভুলভাবে করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে। এসবের ফলে চিকিৎসক ও রোগী মুখোমুখি না বসে, যে যার অবস্থানে বসেও মুঠোফোন বা ল্যাপটপের মাধ্যমে পরামর্শ দিতে ও নিতে সক্ষম। অর্থাৎ স্বাস্থ্যসেবা-ব্যবস্থা বর্তমানে এমন এক অবস্থানে পৌঁছেছে যে যেকোনো প্রান্তিক বা দূরবর্তী এলাকায় বসেও একজন রোগী তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারেন। নিবিড় স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও সার্জারির প্রয়োজন না হলে এখন তাই একজন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকারই পড়ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ও যুগের অনিবার্য প্রয়োজনে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতিও ‘ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা’ প্রবর্তনের উদ্যোগ নিতে চলেছে। এর মাধ্যমে যেকোনো এলাকায় বসেই রোগীরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারবেন, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারবেন।
স্বাস্থ্যসেবায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি
২০২০ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণামূলক নিবন্ধ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রতি ২০ হাজার মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ৫ জন চিকিৎসক ও ৩ জন নার্স। প্রতি এক লাখ রোগীর জন্য রয়েছে মাত্র একটি হাসপাতাল। হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা অনুযায়ী প্রতি চার হাজার রোগীর জন্য রয়েছে মাত্র একটি বেড। অন্যদিকে, ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন জানাচ্ছে, এ দেশে রয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ডায়াবেটিক রোগী। এর বাইরে রয়েছে অন্তত আরও ১ কোটি ৩০ লাখ রোগী, যাঁরা এখনো জানেন না যে তাঁদের ডায়াবেটিস আছে। এ অবস্থায় সব ডায়াবেটিক রোগীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা হতে পারে মোক্ষম ও অনিবার্য পদ্ধতি, যার মাধ্যমে একজন রোগী যেকোনো এলাকায় বসেই প্রায় সব ধরনের বিশেষজ্ঞ সেবা পেতে পারেন।
প্রতিষ্ঠানটি সমিতির ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় তাদের বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে যুক্ত করার পাশাপাশি সমিতির স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা দিতে রাজি আছে। এ ছাড়া সংগঠনটি দরিদ্র রোগীদের ‘টারশিয়ারি কেয়ার’ তথা ইনডোর পর্যায়ের সেবা দিতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ারও ব্যবস্থা করবে। এ ক্ষেত্রে ঋণ দিতে বিভিন্ন ব্যাংকও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে।
ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা যথাযথভাবে দিতে যে ধরনের নেটওয়ার্ক থাকা দরকার, তার সবই আছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির। ঢাকায় বারডেম, এনএইচএন, বিআইএইচএস ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের প্রায় ২৮টি কেন্দ্রের পাশাপাশি সারা দেশে আছে ৭৩টি অধিভুক্ত ও সাব-অধিভুক্ত সমিতি। এর ফলে যেকোনো প্রান্তিক এলাকার রোগীকেও ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার সামর্থ্য আছে সমিতির। বিভিন্ন ধরনের অনলাইন ও অফলাইন সার্টিফিকেট কোর্স চালু করা ছাড়াও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সেবা দেওয়া ও ডায়াবেটিক রোগীদের ডিজিটাল নিবন্ধন করার মাধ্যমেও সমিতি সব সময়েই আধুনিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতির ব্যবহার করে আসছে।
এ রকম একটি অবস্থায় ক্রমবর্ধমান রোগীদের স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনতে হলে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা হতে পারে একটি অনিবার্য ও যথাযথ পদ্ধতি। এই ব্যবস্থায় আইসিইউ ও সার্জারির প্রয়োজন নেই, এমন সব রোগীর হাসপাতালে এসে স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার দরকার পড়বে না। রোগীরা তাঁদের সুবিধামতো বাড়িতে বা অফিসে বসেই যেকোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারবেন। রোগনির্ণয়ের প্রয়োজন দেখা দিলে সমিতির নেটওয়ার্কে যুক্ত নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে তা করে নেওয়া যাবে। বাকি সেবা মুঠোফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করে রোগী নিজের বাসায় বসে অনলাইনেই নিতে পারবেন। এর ফলে হাসপাতালে আসা ও ভর্তির পরিমাণ যথেষ্ট হ্রাস পাবে। দেশের সব প্রান্তে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজলভ্য হয়ে উঠবে।
সমন্বিত ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা
সমন্বিত ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা বা কমপ্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথকেয়ার চালু করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এই ব্যবস্থায় রোগীরা যাতে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বিশেষজ্ঞ সেবার পাশাপাশি রোগনির্ণয় সুবিধাও লাভ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করবে। এর জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা সমিতির স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে যুক্ত করবে। এর বাইরেও প্রান্তিক পর্যায়ে বিশেষ স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলবে। প্রতিটি কেন্দ্রে থাকবে কমপক্ষে একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও একজন নার্স বা প্যারামেডিক্স।
ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য যেসব যন্ত্রপাতি ও অ্যাপস তাদের ব্যবহার করতে হবে, সেসব বিষয়ে তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকবে সহজে বহনযোগ্য (পোর্টেবল) যন্ত্রপাতি এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেস্ট করার জন্য বিশেষ এনালাইজার। এমনকি চোখের ছোটখাটো অপারেশন ছাড়াও ল্যাপারেস্কপিক সার্জারি করার পর স্বল্পকালীন অবস্থানের জন্য এসব কেন্দ্রে থাকবে ডে-কেয়ার ব্যবস্থাও। প্রতিটি কেন্দ্রে থাকবে ছোট ফার্মেসি, যেটি যুক্ত থাকবে বাডাস ফার্মেসি-চেইনের সঙ্গে।
অনলাইন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র সীমাবদ্ধতা—ডাক্তার ও রোগীর পারস্পরিক দূরত্ব। কারণ, চিকিৎসা দিতে রোগীর ইসিজিসহ কিছু প্রয়োজনীয় টেস্টের রিপোর্ট চিকিৎসকের জানা দরকার। এই সীমাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব ছোটখাটো পোর্টেবল যন্ত্রপাতির মাধ্যমে। সারা দেশে অন্তত ৩০০ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এবং ঢাকায় এর মূলকেন্দ্র গড়ে তোলার মাধ্যমে অনলাইনে সারা দেশেই বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সেবা দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ভর্তির দরকার আছে, এমন রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দিতে নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থাও থাকবে।
এ জন্য সারা দেশে অবস্থিত সমিতির নিজস্ব হাসপাতাল ও অধিভুক্ত সমিতির হাসপাতালগুলোকেও নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। যথাযথ চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যথাযথ হাসপাতালগুলোকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হবে। সারা দেশে থাকা বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদেরও এই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হবে। এমনকি সমিতির নেটওয়ার্কের বাইরে থাকা সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোও এই নেটওয়ার্কের আওতায় আসতে পারবে। এর মাধ্যমে প্রয়োজনে রোগীদের ‘টারশিয়ারি’ পর্যায়ের সেবা দেওয়াও সহজ হবে।
এ ধরনের স্বাস্থ্যসেবায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, জাপানসহ উন্নত বিশ্বে কর্মরত বাংলাদেশের অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও। এ বিষয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ইতিমধ্যে সমিতির আলাপ হয়েছে। তাঁরাও এ বিষয়ে যথাসম্ভব সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশেষ করে, সারা দেশের সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোয় দ্রুতগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপকালে তিনিও বাংলাদেশে ডায়াবেটিক সমিতির এ ধরনের উদ্যোগের প্রতি তাঁর সমর্থন প্রকাশ করেছেন।
‘শিওরকেয়ার’
‘শিওরকেয়ার’ নামক আমেরিকাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানও ‘কমপ্রিহেনসিভ ডিজিটাল হেলথ কেয়ার’ বা সমন্বিত ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অংশীদার হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক চৌধুরী হাফিজ আহসানের নেতৃত্বে এই প্রতিষ্ঠান এমন একটি ‘ওয়েবভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন’ ও মুঠোফোন অ্যাপস তৈরি করেছে, যার মাধ্যমে চিকিৎসকেরা সহজেই যেকোনো অবস্থান থেকেই রোগীদের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারেন।
প্রতিষ্ঠানটি সমিতির ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় তাদের বিশেষজ্ঞ প্যানেলকে যুক্ত করার পাশাপাশি সমিতির স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ন্ত্রণেও সহায়তা দিতে রাজি আছে। এ ছাড়া সংগঠনটি দরিদ্র রোগীদের ‘টারশিয়ারি কেয়ার’ তথা ইনডোর পর্যায়ের সেবা দিতে সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ারও ব্যবস্থা করবে। এ ক্ষেত্রে ঋণ দিতে বিভিন্ন ব্যাংকও ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরের যে স্বপ্ন দেখছেন ‘ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা’ তাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যসেবায় এক অসীম সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা এখন আর স্বপ্ন নয়। কারণ, বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা থাকবে মানুষের হাতের মুঠোয়, হাতের নাগালেই।
জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও সমাজকর্মী। সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।
ফরিদ কবির কবি ও প্রাবন্ধিক। পরিচালক (প্রকাশনা ও জনসংযোগ), বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি।