আদতে গাজায় মানুষ মারছে যুক্তরাষ্ট্র

রাফায় ধ্বংসস্তূপে আহত শিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এক ফিলিস্তিনি নারীছবি: এএফপি

‘কোনো প্রশাসনই ইসরায়েলকে আমার চেয়ে বেশি সহায়তা করেনি। কেউ না, কেউই না’—সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই মন্তব্য করেছেন। তিনি যখন এ কথা বলছিলেন, তখন গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে পা রেখেছে।

তিনি যখন এই মন্তব্য করছিলেন, তখন গাজায় নিহতের সংখ্যা প্রায় অর্ধলাখে পৌঁছে গেছে, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। নিজেকে ‘জায়নবাদী’ হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেন অবশ্য ভুল কিছু বলেননি।
এটি সত্য, পূর্ববর্তী সব মার্কিন প্রশাসন ইসরায়েলকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে এসেছে।

তবে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেন আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তেল আবিবের যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক মদদ শুধু বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারকে দীর্ঘতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তাই করেনি, বরং তা সংঘাতটিকে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতে ছড়িয়েও দিয়েছে।

এক বছরের ধ্বংসাত্মক বিমান হামলায় ও স্থল আক্রমণে জায়নবাদী বাহিনী গাজাকে একটি মৃত্যুকূপে পরিণত করেছে। তারা গাজার সব জনগণকে বাস্তুচ্যুত করেছে। অন্যদিকে, দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে শত শত ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এমন ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ দেখা যায়নি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু পশ্চিমা দেশের সমর্থন ইসরায়েলকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দিয়ে বসে আছে।

বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন দেওয়ায় অনেক পর্যবেক্ষক আমেরিকাকে যুদ্ধাপরাধের দোসর বলে আখ্যায়িত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে গাজা যুদ্ধকে এখন আমেরিকার যুদ্ধ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্টস অব ওয়ার’ প্রজেক্টের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলে ১৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে, যার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। এটি ইসরায়েলের জন্য এক বছরে দেওয়া আমেরিকার সর্বাধিক সামরিক সহায়তা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কিন প্রশাসন এই সহায়তার প্রকৃত পরিমাণ গোপন করার চেষ্টা করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে ইসরায়েল ১৯৫৯ সাল থেকে ইতিহাসের সর্বাধিক মার্কিন সামরিক সহায়তা পেয়েছে। বর্তমান প্রশাসনের বিশাল সামরিক সহায়তার পাশাপাশি মার্কিন কংগ্রেসে জায়নবাদী শাসনের পক্ষে ব্যাপক দ্বিদলীয় সমর্থন রয়েছে। কোনো মার্কিন প্রশাসনই শক্তিশালী ইসরায়েলি লবির বিরোধিতা করার সামর্থ্য রাখে না, কারণ এই লবি কার্যত কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করে।

এর বাইরে এই অঞ্চলে সামরিক অভিযানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ৪ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। এই অর্থ ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। গত এক বছরে আমেরিকান সহায়তামূলত সামরিক অর্থায়ন, অস্ত্র বিক্রি এবং মার্কিন মজুত থেকে স্থানান্তরের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকা যেসব অস্ত্র দিয়েছে, তার একটি বড় অংশে রয়েছে আর্টিলারি শেল এবং ২ হাজার পাউন্ড ওজনের বোমা। এসব বোমা ইসরায়েল গাজার জনগণের ওপর নির্বিচারে ফেলে যাচ্ছে।

যদিও ওয়াশিংটন মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বেসামরিক মানুষদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং কিছু ভারী বোমার চালান অস্থায়ীভাবে স্থগিত করেছে; তবে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ বাড়তে থাকলেও মার্কিন সামরিক সহায়তার জন্য ইসরায়েলের ওপর কোনো ধরনের শর্ত আরোপ করতে তারা অস্বীকার করেছে। লেবাননে বর্তমানে চলমান নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ওয়াশিংটন নীরব রয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা বোমা ফেলে ইসরায়েলের বিধ্বংসী বিমান এক হাজারেরও বেশি মানুষ মেরে ফেলেছে।

আরও পড়ুন

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে ইসরায়েল ১৯৫৯ সাল থেকে ইতিহাসের সর্বাধিক মার্কিন সামরিক সহায়তা পেয়েছে। বর্তমান প্রশাসনের বিশাল সামরিক সহায়তার পাশাপাশি মার্কিন কংগ্রেসে জায়নবাদী শাসনের পক্ষে ব্যাপক দ্বিদলীয় সমর্থন রয়েছে। কোনো মার্কিন প্রশাসনই শক্তিশালী ইসরায়েলি লবির বিরোধিতা করার সামর্থ্য রাখে না, কারণ এই লবি কার্যত কংগ্রেস নিয়ন্ত্রণ করে।

এই গণহত্যামূলক যুদ্ধের শীর্ষ পর্যায়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে (যাঁর বিরুদ্ধে কয়েক মাস আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়েছিলেন) গত জুলাই মাসে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে যখন তিনি তাঁর গণহত্যাকে ন্যায্যতা দিয়ে এই যুদ্ধকে ‘বর্বরতা ও সভ্যতার সংঘর্ষ’ বলে অভিহিত করেন, তখন উভয় পক্ষের আইনপ্রণেতারা বারবার দাঁড়িয়ে তাঁকে অভিবাদন জানিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র দৃশ্যত নেতানিয়াহুর এই অবস্থানকে সমর্থন দিচ্ছে। তবে তাদের সমর্থন নিয়ে ইসরায়েল যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তা তাদের জন্য কঠিন পরিণতি বয়ে আনতে পারে।  

  • জাহিদ হুসাইন পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক

    ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত