চট্টগ্রাম নগরকে জলাবদ্ধতামুক্ত করতে সবচেয়ে বড় প্রকল্পের কাজ থেমে আছে অর্থের অভাবে। এ খবর চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের চরম হতাশ করেছে। অনিবার্য নিয়তির মতো জলাবদ্ধতার ক্ষত থেকে নিস্তার পাচ্ছে না সহজেই। এটা যেন এক মরণব্যাধি, যা চট্টগ্রাম নগরকে রোগশয্যা থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।
এই কঠিন সংকট থেকে উত্তরণে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক), সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সবগুলো প্রকল্প ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’–এর মতো অনিঃশেষ দুঃখের মতো লেগে আছে চট্টগ্রামের কপালে।
চারটি প্রকল্পের সবচেয়ে বড় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করছে চউক। চট্টগ্রামবাসীর মনের স্বপ্নের সঙ্গে সংগতি রেখে এই প্রকল্পের নাম রাখা হয়েছে ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্প। আজ থেকে প্রায় অর্ধযুগ আগে শুরু হয় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম শহর বারবার পানির তলায় ডুবেছে। এখানকার মানুষদের নরকযন্ত্রণায় ভাসিয়েছে কতবার! হয়েছে প্রাণহানি, সম্পদহানি।
কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ হয় না। তিন বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালেই কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও পরে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। জুনও চলে গেছে চার মাস হলো। সর্বশেষ খবরে জানা যায়, জুনেই মেয়াদ কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে মন্ত্রণালয় বর্তমান অর্থবছরে প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ টাকা আর ছাড় করতে পারছে না। এ কারণেই প্রকল্পের কাজ থেমে আছে। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো না গেলে অর্থ ছাড়ও পাওয়া যাবে না। মেয়াদ বাড়াতে লাগবে একনেকের অনুমোদন। এখন পুরো প্রকল্পটির ভাগ্য একনেকের সভার ওপর নির্ভর করছে। এই সভায় অনুমোদন না পেলে এর বাস্তবায়ন কাজ বন্ধ হয়ে যাবে।
২০১৭ সালে এই প্রকল্পের কাজ যখন শুরু হয়, তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা। ২০২১ সালে আয়তন বাড়িয়ে ১০ হাজার ৪২০ কোটি টাকার সংশোধিত ডিপিপি প্রস্তাব করে চউক। কিন্তু এই সংশোধিত প্রস্তাবটি গ্রহণ করলেও মূল্যায়ন কমিটি প্রকল্প ব্যয় কমিয়ে আনে। শেষ পর্যন্ত এর ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। এই বাড়তি ৩ হাজার ১২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা অর্থবিভাগ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আরডিপিপি অনুমোদন না হলে অর্থ ছাড়ের সুযোগ নেই। তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি মূল্যায়ন কমিটি হয়ে একনেকে অনুমোদন পাবে বলে তিনি আশাবাদী। কিন্তু চট্টগ্রামবাসীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কেননা, এই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই এখন অবধি করা হয়নি। এই প্রকল্পের প্রধান ও প্রথম কাজ ছিল চট্টগ্রামের যেসব খাল জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী, সেগুলোকে পুনঃখনন ও সম্প্রসারণ করা।
চট্টগ্রামে রয়েছে মোট ৫৭টি খাল। তার মধ্যে ৩৬টি খালের পুনঃখনন ও সংস্কার করার কথা আছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে। এই ৩৬টি খালের প্রায় সব কটির কাজ শেষের পথে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাক্তাই খাল, চাক্তাই ডাইভারসন খাল ও গয়নাছড়া খালের কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম নগরের দুঃখ বলে খ্যাত চাক্তাই খালই এ শহরের বেশির ভাগ এলাকার জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে দশকের পর দশক এই খালের ওপর চলেছে দখলমত্ততা। যে যাঁর ইচ্ছেমতো এই খালের দুই পাড়ে মানুষ তাঁদের স্থাপনা বিস্তৃত করেছেন।
দিন দিন সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর হয়েছে খাল। অথচ নগরের প্রায় সব অঞ্চলের পানি এই খালটির ওপরেই এসে পড়ে। শেষ পর্যন্ত এ খালটিই নগরবাসীর ভোগান্তির অন্যতম কারণ হয়ে পড়ে। দখল দূষণে সংকীর্ণ এই খালের পুনঃখনন ও সংস্কারের কাজ শুরু হওয়ার পর মানুষ আশ্বস্ত হয়েছিল। কাজ দেখে আশা জেগেছিল। সেই আশায় কেটে গেল প্রায় ছয় বছর। এখন আবার শঙ্কা জাগে বুকে। কারণ, চাক্তাই খালের কাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এটি শেষ করা না গেলে এই নগর পুরোপুরি জলাবদ্ধতার গ্রাস থেকে মুক্ত হবে না।
কোটি কোটি টাকা জলেই নষ্ট হবে? হয়তো না। আমাদের বিশ্বাস তীরে এসে তরি কখনো ডুববে না। এত বড় কাজ একেবারে শেষের দিকে এসে বন্ধ কখনো হবে না। লাখো মানুষের ভোগান্তির কথা, বন্দর নগর চট্টগ্রামের গুরুত্ব আর মর্যাদার কথা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিবেচনার মধ্যে থাকবে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এই প্রকল্প ছাড়া আরও তিনটি প্রকল্পের কাজ চলছে আট বছর ধরে। এগুলো বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। বাস্তবায়নে নিযুক্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভিযোগ ওঠে সব সময়। শুধু ৩৬টি খাল সংস্কার হলে স্থায়ী সমাধান আসবে না। বাকি ২৯টি খালও সংস্কারের আওতায় আনতে হবে। সিটি করপোরেশন সেগুলোর দায়িত্ব নিতে হবে।
পানি উন্নয়ন প্রকল্পের নাম ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/ জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’। এই প্রকল্পেরও মূল উদ্দেশ্য চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতামুক্ত করা। এই লক্ষ্যে পাম্পহাউস স্থাপন, খাল খনন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শহর এলাকায় লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঠেকানো, কর্ণফুলী নদীর ডান তীরে প্রতিরোধ দেয়াল স্থাপনের কাজ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
২০১৮ সালে শুরু হয়েছে এই কাজ। আগামী বছর এসব কাজ শেষ হওয়ার কথা। মেয়াদকাল প্রায় শেষ হলেও তীর সংরক্ষণের কাজ ছাড়া অনেক কাজ এখনো বাকি। চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা এই প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না। বৃষ্টির মৌসুম শেষ। আরেকবার বর্ষা আসার আগে মানুষের জীবন থেকে জলাবদ্ধতার অভিশাপ বিলীন হয়ে যাক।
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক