সাংগ্রি-লা সংলাপ: এশিয়ার নিরাপত্তা নিয়েই আলোচনা নেই

‘সাংগ্রি-লা সংলাপ’ শীর্ষক নিরাপত্তা সম্মেলনে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফু
ছবি: এএফপি

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর ‘সাংগ্রি-লা সংলাপ’ শীর্ষক নিরাপত্তা সম্মেলন সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে শেষ হলো। এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা সম্মেলন হিসেবে পরিচিত। এ বছরের এই সম্মেলনের প্রেক্ষাপট খুব একটা অনুকূল ছিল না। কারণ, একদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার রক্তক্ষয়ী আগ্রাসন চলছে; অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আপসহীনভাবে তাঁর বৈশ্বিক নজর সম্প্রসারিত করা অব্যাহত রেখে চলেছেন।

দুই দিনের এই প্রতিরক্ষা সম্মেলনে যে বিষয়টি নিশ্চিত বলে প্রতীয়মান হয়েছে, সেটি হলো চীন ও আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা কার্যকরভাবে সামাল দেওয়া সুদূরপরাহত। এই দুই দেশের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। দুই দেশের সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকও আগের চেয়ে সীমিত হয়ে পড়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন দুই দেশের আলোচনা পুনরায় শুরু করার একটা চেষ্টা করলেও চলতি বছরের গোড়ার দিকে আমেরিকার আকাশে চীনা গোয়েন্দা বেলুনের উপস্থিতি সেই চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয়।

দুই দেশের কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার পারস্পরিক যোগাযোগ হচ্ছে এবং সেসব যোগাযোগ সম্ভাব্য উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সরকারি সফরের পথ প্রশস্ত করছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে চীনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুনরায় মিলমিশ করার বিষয়ে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।

তাইওয়ান নিয়ে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিয়ত চীনের সামরিক বিমান ও নৌযান নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে আমেরিকার অংশীদারেরা চায় চীন কথা বলুক। তারা বলছে, দুই দেশের কূটনীতিতে আত্মবিশ্বাস গড়তে সামরিক কর্মকর্তাদের যোগাযোগ বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে।

সাংগ্রি-লা সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপনের সময় অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ অধিক সংখ্যক সংলাপকে মার্কিন-চীন সম্পর্কের ‘প্রথম এবং সবচেয়ে মৌলিক’ পন্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সম্মেলনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ওপর জোর দেন, বিশেষ করে তিনি সামরিক নেতাদের মধ্যে সংলাপের ওপর জোর দেন।

এ ছাড়া তিনি ‘বিতর্কিত অঞ্চলে’ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর মতোই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য নেতারাও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই দুই শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই অঞ্চলকে কোথায় নেবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

দুই দেশের নেতাদের কথা বলার সঠিক সময় অস্টিনের ভাষায় ‘অ্যানি টাইম অ্যান্ড এভরিটাইম’ (যেকোনো সময় এবং সব সময়)। অস্টিনের এই উষ্ণ আবেদনের পরও চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি শাংফু তাতে সাড়া দেননি। এতে অবশ্য অবাক হওয়ার কিছু নেইও। কারণ, রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনার কারণে ২০১৮ সাল থেকে লির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। তবে, বৃহত্তর প্রতিরক্ষা কূটনীতির প্রতি চীনের এই গোঁয়ার্তুমিধর্মী বিরোধিতা অমার্জনীয়।

দুই দেশের মধ্যে আস্থা বাড়াতে আকাশ ও নৌসীমা নিরুপদ্রব রাখার প্রস্তাব প্রসঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লি বলেছেন, সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সামরিক কর্মকর্তাদের সংলাপ কোনো সমাধানসূত্র থাকতে পারে না; এর চেয়ে চীনের আকাশ ও জলসীমা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পশ্চিমের নিজের চরকায় তেল দেওয়া উচিত হবে। লি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার অংশীদারেরা নৌপথের স্বাধীনতার নামে মূলত নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। তিনি বলেছেন, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের নিজস্ব আচরণ নিয়ে নিরীক্ষা করার কোনো আগ্রহ নেই।

সম্মেলনে দ্বিতীয় যে উদ্বেগের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে, সেটি হলো ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন। এই যুদ্ধটি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ঘনিষ্ঠ অংশীদারদের আচ্ছন্ন করছে, ঠিক তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এ বিষয়ে উদাসীন রয়ে গেছে। এশিয়ায় অনুরূপ পরিস্থিতির আশঙ্কা এড়াতে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করা উচিত—এই যুক্তি সম্মেলনে বারবার প্রচার করা হয়েছে। পশ্চিমের দিক থেকে এ বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এশিয়ার অনেক স্বল্পোন্নত দেশের কাছে এই যুদ্ধ–সম্পর্কিত রাশিয়ান ও চীনা বর্ণনা বেশি আকর্ষণ অর্জন করেছে। তারাও এই যুদ্ধের জন্য ন্যাটোর ‘উসকানি’কে দায়ী করেছে।

আরও পড়ুন

ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রবোও সুবিয়ান্তো একটি আপৎকালীন শান্তি প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এখন যে অবস্থায় রয়েছে, সেই অবস্থায় একটি নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল ঘোষণা করা যেতে পারে।

এ ছাড়া তিনি ‘বিতর্কিত অঞ্চলে’ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর মতোই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য নেতারাও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে যেকোনো একটি পক্ষকে বেছে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই দুই শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই অঞ্চলকে কোথায় নেবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো উদ্বেগ আছে বলে মনে হচ্ছে না।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • রিচার্ড মাউডে এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের একজন সিনিয়র ফেলো