বছর ঘুরে আবারও আসছে দেবী দুর্গার আরাধনার শুভক্ষণ। প্রতিবারই বহু প্রতীক্ষার পর দুর্গাপূজা নিয়ে আসে শান্তির বারতা, সম্প্রীতির বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ করার প্রয়াসে। সচরাচর দুর্গোৎসবের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর মহিমা কারোরই অজানা নয়। তাই চলতি লেখাটিতে পূজায় সম্প্রতি কয়েক বছর ধরে চলে আসা দৃষ্টিকটু বিষয়গুলো তুলে ধরার পাশাপাশি কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব নজরে আনা সময়োপযোগী মনে করছি।
ধারাবাহিকভাবে বলতে গেলে প্রথমেই আসে দেবী দুর্গার প্রতিমা প্রসঙ্গ। খুব স্বাভাবিকভাবেই আগের তুলনায় দেবীর প্রতিমায় ভিন্নতা আসছে।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এমন পরিবর্তন গ্রহণযোগ্যতা পেলেও কিছু ক্ষেত্রে তা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে না-এমন দাবি করতে পারি না। দুর্গা প্রতিমা ছাড়াও সরস্বতী, লক্ষ্মীসহ অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিমায় অতিমাত্রায় আধুনিকতা শালীনতাকে পাশ কাটিয়ে গেছে কোথাও কোথাও। সিনেমার নায়িকা বা মডেলদের আদলে দেবী প্রতিমার রূপ দিতে গিয়ে আমরা ধর্মকে হাসির বস্তুতে পরিণত করছি না তো আবার?
গত কয়েক বছরে দুর্গোৎসবে আমরা প্যান্ডেল ও আলোকসজ্জায় তুলনামূলক বেশি ব্যয় করার রীতি লক্ষ করে আসছি। ডেকোরেশন ও আলোকসজ্জায় মণ্ডপে মণ্ডপে সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতা তো আছেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয় মাত্রাতিরিক্ত জোরাল সাউন্ড সিস্টেমে ডিজে গান। মণ্ডপগুলোতে ধর্মীয় গান, চণ্ডীপাঠ ও কীর্তন বাজানো কমেই গেছে বলা চলে। কী সব অশ্লীল, অশ্রাব্য ধাঁচের গান বাজানো হয়, যা হয়তো বিনোদনমুখী, কিন্তু অপসংস্কৃতির উপাদান বললেও ভুল হবে না। গানগুলোর অর্থ, সুর, তাল, লয়-কোনোটারই সমন্বয় নেই, শুধু কর্কশ শব্দ। কিছু ক্ষেত্রে মন্দিরগুলোতে এত বেশি উচ্চ শব্দে ডিজে গান বাজানো হয়, তাতে করে দর্শনার্থী বা ভক্তদের প্রতিমা দর্শনই দায় হয়ে দাঁড়ায়।
আরেকটি পীড়াদায়ক বিষয় হলো-পূজায় কোথাও কোথাও মাদক সেবন করে চলে উত্তাল নাচ, যা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সনাতন ধর্ম সম্বন্ধে নেতিবাচক ধারণা দেয়। ছোট করে দেয় আমাদের আরাধনাপদ্ধতিকে। বিনোদন বিকৃতভাবেই কেন নিতে হবে? ভালো অনেক উপায়ই তো রয়েছে। এভাবে কি আমরা ভাবতে পারি না?
উৎসবের আনন্দে মেতে উঠতে ডেকোরেশন, আলোকসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেমের বিপক্ষে আমি নই, কিন্তু স্বাভাবিক মাত্রাকে ছাপিয়ে যাওয়ার বিপক্ষেই মূলত আমার অবস্থান। পূর্বোক্ত বিষয়গুলো মাত্রার মধ্যে রেখেও কিন্তু আনন্দ করা সম্ভব, এবং সেটিই সমাজের সবার চোখে মানানসই। পক্ষান্তরে আমরা এর বিপরীতে যতই যেতে থাকব, ঠিক ততই বিরক্তির কারণ হব। ক্ষুণ্ন হবে সনাতন ধর্মের গৌরবময় সম্মান। স্বধর্মের বিকৃত উপস্থাপনার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী থাকব।
আমরা আবার ফিরে যেতে পারি আগের মতো সুস্থ পূজার্চনার সংস্কৃতিতে। ধুনুচি আরতি, শঙ্খধ্বনি, গীতাপাঠ, চণ্ডীপাঠ, ধর্মীয় কুইজ প্রতিযোগিতা ও ধর্মীয় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। কয়েক বছর আগেও কিন্তু এমন সুস্থ সংস্কৃতি সনাতনীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে চলমান ছিল, এখনো সারা দেশের অনেক জায়গায় চলে। ধূমপান, মদ্যপান, নেশাদ্রব্য গ্রহণ, তাস খেলাসহ সব ধরনের বাজে ব্যবহার মুক্ত করতে হবে পবিত্র পূজামণ্ডপ। পাশে থাকা অন্য পূজামণ্ডপের সঙ্গে কোনো প্রকার প্রতিযোগিতা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। পূজার প্যান্ডেল, আলোকসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেমের বাজেট কমিয়ে দুস্থদের মধ্যে পূজাসামগ্রী (নারকেল, মুড়ি, চিড়া, গুড়, চিনি ইত্যাদি), বস্ত্রদান, মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনার মতো অনেক জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
আমরা আবার ফিরে যেতে পারি আগের মতো সুস্থ পূজার্চনার সংস্কৃতিতে। ধুনুচি আরতি, শঙ্খধ্বনি, গীতাপাঠ, চণ্ডীপাঠ, ধর্মীয় কুইজ প্রতিযোগিতা ও ধর্মীয় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে
পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ধর্মজ্ঞান, শিক্ষা, সনাতনী রীতি ও সঠিক ইতিহাস পৌঁছাতে হবে। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। অন্যথায় তারা অনাচারকেই আচার হিসেবে আত্মস্থ করবে। খেয়াল রাখতে হবে, পূজা দেখা ও মনোরঞ্জনেই যাতে মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে না যায়। আমরা অপসংস্কৃতির ছোবল থেকে মুক্ত করে পূজাকে করতে চাই শুদ্ধ ও সাত্ত্বিক। তরুণ ও যুবসমাজকে বিপথে যেতে দেখলে মনটা আশঙ্কার মেঘে ঢাকা পড়ে। আমরা সেই অপসংস্কৃতির মেঘের ভয়কে জয় করতে চাই। ধর্মকে সমুন্নত রেখেই আমরা এগিয়ে চলব সমৃদ্ধির রথে, সম্প্রীতির পথে। সবাইকে শারদীয় শুভেচ্ছা।
শিপন রবিদাস প্রাণকৃষ্ণ বাংলাদেশ রবিদাস ফোরামের (বিআরএফ) সাধারণ সম্পাদক।