‘মামাবাড়ির আবদার’ কথাটি আমাদের বাংলা ভাষায় যথেষ্ট পরিচিত। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ভাষায় ঠিক এ রকম অভিব্যক্তি প্রচলিত কি না, তা আমার সঠিক জানা নেই। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং সেসব দেশের প্রতিষ্ঠিত আধিপত্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ঠিক এ রকম অভিব্যক্তি যে নেই, তা হলফ করে বলা যায়। এর কারণ সম্ভবত মামা ও ভাগনের মধ্যে সেসব দেশে বিরাজমান সম্পর্কে তৈরি হওয়া দূরত্ব।
সম্পর্কে সে রকম দূরত্ব বজায় থাকায় ভাগনেরা সেখানে মামাদের কাছে আবদার তুলে হাজির হয় না এবং মামাদেরও ভাগনের আবদার মেটানোর মতো বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না।
তবে অভিব্যক্তির অনুপস্থিতি সত্ত্বেও মামার কাছে ভাগনের আবদার নিয়ে হাজির হওয়ার ঘটনা যে সেই অঞ্চলে একেবারেই নেই, তা অবশ্য বলা যায় না। ঠিক সে রকম এক দৃষ্টান্ত নিয়ে সম্প্রতি রাজনীতির বিশ্বমঞ্চে নতুন খেলা দেখাতে হাজির হয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
পশ্চিমা বিশ্বে জেলেনস্কির অবশ্য মামার অভাব নেই। নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য রাশিয়াকে ঘায়েল করার খেলা সেই মামারা চালিয়ে যাচ্ছেন বেশ কয়েক বছর ধরে এবং তাঁদের সেই প্রচেষ্টায় দাবার ঘুঁটি হয়ে খেলে চলেছেন তাঁদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেই ভাগনে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট।
চলতি মাসের ১৫ ও ১৬ তারিখ সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইউক্রেন ‘শান্তি সম্মেলন’। শান্তি সম্মেলন শব্দটি আমি এ কারণে ঊর্ধ্ব কমার ভেতরে রেখেছি, সেই সম্মেলন হতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ অর্থেই একতরফা।
সংঘাত নিরসনের উদ্দেশ্যে আয়োজন করা যেকোনো ধরনের শান্তি আলোচনায় যুদ্ধে জড়িত বিভিন্ন পক্ষের উপস্থিতি হচ্ছে আবশ্যকীয় এক পূর্বশর্ত। কেননা কোনো একটি পক্ষকে সেই আলোচনার বাইরে রাখার অর্থ হচ্ছে, যোগদানকারী পক্ষের নির্ধারণ করে নেওয়া শর্তাবলি সেই পক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। এ ধরনের উদ্যোগ থেকে ইতিবাচক কিছু অর্জন করা হচ্ছে একেবারেই অসম্ভব।
সুইজারল্যান্ড নির্ধারিত মামা আর ভাগনের সেই শান্তি নামের খেলায় সে রকম কিছুই হতে যাচ্ছে কারণ রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসাকে ইউক্রেনের সরকার ইতিমধ্যে হারাম ঘোষণা করে বসে আছে। আর এ কারণেই সম্মেলন সফল করার জন্য চাপ দিয়ে হলেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাষ্ট্রের উপস্থিতি নিশ্চিত করে নিতে ভাগনে এখন মামাদের শরণাপন্ন হয়ে আবদার তুলেছেন যে তাঁদের নির্ধারিত শর্তেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং রাশিয়া সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবে না।
মামাদের চাপের মুখে দক্ষিণের বিশ্বের বেশ কিছু দেশকে সেখানে হাজিরা অবশ্যই দিতে হবে। তবে এর থেকে অর্জন কিছুই না হয়ে যা পাওয়া যাবে তা হচ্ছে, বিভক্ত বিশ্বের বিভক্তি আরও পরিষ্কারভাবে প্রকাশ হয়ে পড়া। কেননা এ রকম কিছু একটাই যে শুরু থেকে তাঁরা চেয়ে আসছেন, শান্তি সম্মেলনের নামে একতরফা আয়োজনের অনেক আগেই তা বিশ্ববাসীর সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে।
ইউক্রেনের এই আবদার যে একেবারেই অর্থহীন, অন্যদের অবশ্য তা অনুধাবন করতে খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি। ফলে তাদের পক্ষ থেকে চীন ও ব্রাজিল এখন ইউক্রেনের প্রস্তাবের বিপরীতে শান্তি আলোচনা বিষয়ে নিজস্ব প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হয়ে বলছে, সব পক্ষের অংশগ্রহণ ছাড়া অর্থহীন আলোচনা হবে কেবল সময় আর অর্থের অপচয়। ফলে সেই দুই দেশের উত্থাপিত শান্তি প্রস্তাবে ইউক্রেন ও রাশিয়ার অংশগ্রহণকে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে ধরে নিয়ে বলা হয়েছে, শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্যান্য শর্তাবলি আলোচনার মধ্যে দিয়েই নিশ্চিত করে নেওয়া হবে।
তবে মামাদের পেছনে আবদারের বাগড়া নিয়ে কাপড় ঝুলে বসে থাকা ভাগনে তা মেনে নিতে একেবারেই নারাজ। কেননা ভাগনের জানা আছে, সে রকম কিছু হলে আম ও ছালা দুটিই হারাতে হবে। ফলে ভাগনে এখন বলছে শান্তির সংজ্ঞা কীভাবে নির্ধারণ করা হবে, তা নিশ্চিত করে নেওয়ার অধিকার একমাত্র তার এবং অন্য কেউ এতে আগ বাড়িয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
মামারাও অবশ্য ভাগনের এই অযৌক্তিক যুক্তিকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাতে শুরু করেছেন। কেননা যুদ্ধ থেমে গিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে ইউরোপ এগিয়ে যাক, মামাদের পালের গোদা সে রকম কিছু দেখতে একেবারেই নারাজ।
তাঁদের কাছে যুদ্ধ চলমান থাকার অর্থ হচ্ছে অস্ত্র সরবরাহের নামে নিজেদের অত্যন্ত লাভজনক মৃত্যুর বাণিজ্য সচল রেখে যাওয়া, অর্থনীতিতে ক্ষয় ধরা, এই সময়ে যা কিনা খুবই প্রয়োজন। আর সেই সঙ্গে দায়িত্ব পালনের বৈধতার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া ভাগনের জন্যও সে রকম অবস্থা বজায় থাকা হচ্ছে ক্ষমতার রশি আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য খুবই জুতসই এক যুক্তি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হতে যাচ্ছে, সুইজারল্যান্ডে নির্ধারিত চলতি মাসের ‘শান্তি সম্মেলনে’।
মামাদের চাপের মুখে দক্ষিণের বিশ্বের বেশ কিছু দেশকে সেখানে হাজিরা অবশ্যই দিতে হবে। তবে এর থেকে অর্জন কিছুই না হয়ে যা পাওয়া যাবে তা হচ্ছে, বিভক্ত বিশ্বের বিভক্তি আরও পরিষ্কারভাবে প্রকাশ হয়ে পড়া। কেননা এ রকম কিছু একটাই যে শুরু থেকে তাঁরা চেয়ে আসছেন, শান্তি সম্মেলনের নামে একতরফা আয়োজনের অনেক আগেই তা বিশ্ববাসীর সামনে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে।
ফলে চীন, ব্রাজিলের উদ্যোগও যেন এগিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য তাদের পক্ষ থেকে এখন চালানো হচ্ছে জোর প্রচারণা, শান্তির সংজ্ঞা নির্ধারণের একচেটিয়া অধিকারের মতো বালখিল্য আবদারও তাই পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে হয়ে উঠছে যৌক্তিক।
তবে তা সত্ত্বেও চীন, ব্রাজিলসহ দক্ষিণের বিশ্বের বেশ কিছু দেশের জোরালো ভূমিকা অন্যদিকে যা দেখিয়ে দিচ্ছে তা হলো, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মামাবাড়ির আবদারের কোনো স্থান নেই এবং যুক্তিসংগত শর্ত ও কাঠামোর ভিত্তিতে চালানো শান্তি আলোচনা হচ্ছে সমস্যা সমাধান করে নেওয়ার একমাত্র ও বৈধ পথ।
আমাদের নীতিনির্ধারকেরাও অযৌক্তিক বিভিন্ন চাপ উপেক্ষা করে সেই পথ ধরে হেঁটে যাবেন, সেটাই আমাদের কাম্য। ফলে চীন ও ব্রাজিলের দেখিয়ে দেওয়া পথই যে হচ্ছে শান্তি ফিরিয়ে আনার একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প, সেই অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হলেও সেটা হবে প্রযোজ্য।
মনজুরুল হক সাংবাদিক