চরম বৈষম্যপূর্ণ উন্নয়নের তলানিতে পড়ে থাকা রংপুরের উন্নয়নে পর্যাপ্ত বরাদ্দ চেয়ে বিভিন্ন সময় অনেক কর্মসূচি পালিত হয়। এবার নগরীর খোকসা ঘাঘট নদের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য বরাদ্দ করা টাকা যাতে ফেরত না যায়, সে জন্য মানববন্ধন করতে হলো কয়েকটি সংগঠনকে। রংপুরের কী নিয়তি!
রংপুর নগরীর সাতমাথার কাছেই শ্যামাসুন্দরী, কেডি, বুড়াইল, ইছামতী নামের কয়েকটি জলধারা মিলিত হয়েছে। মিলিত হওয়ার পরের প্রবাহের নাম হয়েছে খোকসা ঘাঘট নদ। নদটিতে স্বচ্ছ পানির ধারা ও তীব্র স্রোত ছিল, নৌকাও চলত। নদটি প্রায় আট কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর দমদমা নামক স্থানে ঘাঘট নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ১ হাজার ৮টি নদীর তালিকাসমৃদ্ধ বইতে খোকসা ঘাঘট নদের নাম নেই। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারাইন পিপল ক্লাব কয়েক মাস আগে সেখানে একটি সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে। সাইনবোর্ডে লেখা, ‘আমি খোকসা ঘাঘট নদী। আইনগতভাবে জীবন্ত সত্তা। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আমাকে তালিকাভুক্ত করেনি। আমার মতো শত শত নদীর পাশে দাঁড়াও।’
নগরীর ভেতর জমির দাম অনেক বেশি। ফলে নদের পাড়ে দখলদারও খুব সক্রিয়। এ নদের অনেক স্থানে অবৈধ দখল হয়েছে, গড়ে উঠেছে অনেক স্থাপনা। নদটিতে যে কটি সেতু আছে, তার প্রতিটি প্রায় এর প্রকৃত প্রস্থের চেয়ে কম।
২০২০ সালে একবার জেলা প্রশাসন কর্তৃক নদীর দুই পারের অনেক স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান তখন ছিলেন মুজিবুর রহমান হাওলাদার। তিনি সরেজমিন নদীটি পরিদর্শন করে অবৈধ দখল উচ্ছেদের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে সময়কার জেলা প্রশাসক আসিব আহসানও উচ্ছেদ কার্যক্রমে ছিলেন আন্তরিক।
খোকসা ঘাঘট থেকে অবৈধ স্থাপনা তুলে দেওয়ার পর জেলা নদী রক্ষা কমিটির সভায় এ নদীর সৌন্দর্য বৃদ্ধির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (পাউবো) প্রকল্প গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। স্থপতি অনিক রেজা নকশা করে দিয়েছেন। এরপর পাউবোর একটি প্রকল্প অনুমোদন পায়। সেটির বাস্তবায়নের জন্য টেন্ডার আহ্বান, ঠিকাদার নিয়োগ সবই হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ছিল ১ কোটি ৯ লাখ টাকার প্রকল্প।
চলতি অর্থবছরের মধ্যে কাজ করা না হলে এ টাকা ফেরত যাবে। যাদের কারণে টাকা ফেরত যাচ্ছে, অনুসন্ধান করলে তাদের অযোগ্যতা কিংবা ব্যক্তিগত লাভালাভের কোনো বিষয় উঠে আসবে বলে আমরা মনে করি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এই নদের পাশেই অবস্থিত। এ নদ হতে পারে নগরবাসীর জন্য বিনোদনের অনন্য স্থান। দখলমুক্ত করে নদটির দুই পাড় যদি সাজানো যায়, তাহলে পুরো রংপুরের মানুষ এ নদীর পাড়ে বিকেল-সন্ধ্যা কিংবা ছুটির দিন কাটাতে আসবেন। অসুন্দর নগরে সামান্য সৌন্দর্যও কি বৃদ্ধি পাবে না?
আমরা বারবার তাগিদ দিলেও ওই সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু হয়নি। পাউবোর কর্মকর্তারা বলেন, জেলা প্রশাসনের অনাপত্তি পেলেই তাঁরা কাজ শুরু করবেন। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে এ কাজ শুরু হলো না। নদীর পারে কিছু স্থানে কয়েকজন ব্যক্তিমালিকানা দাবি করে উচ্চ আদালত এবং জেলা জজ আদালতে মামলা করেছেন। সিএস মূলে যা নদী, তার মালিকানা ব্যক্তি লাভ করার সুযোগ নেই। এরপরও যে কেউ আইনি প্রতিকার চাইতে পারেন।
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কিংবা সেখানে কোনো কাজ করতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা নেই। এরপরও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু করা হয়নি। আইনি স্বচ্ছতার জন্য রংপুরের সরকারি কৌঁসুলির কাছে মতামত চাওয়া হয়েছিল।
সরকারি কৌঁসুলি ২৩ এপ্রিল ২০২৪ লিখিত আইনগত মতামতে লিখেছেন, ‘উক্ত মোকদ্দমায় কোনো অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার দরখাস্ত বিচারাধীন নাই এবং দাখিলও হয় নাই। কাজেই অবৈধ দখলদারদেরকে দ্রুত উচ্ছেদ করিবার জন্য আইনগত মতামত প্রদান করা হইল।’ নদীর পারে মামলা-মোকদ্দমা ছাড়াও অনেক জায়গা আছে।
জেলা প্রশাসক আসিব আহসান বদলি হয়ে যাওয়ার পর আবারও নদীর জায়গায় অনেক স্থাপনা তৈরি হয়, আছে বহুতল ভবনও। এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে আইনগত কোনো বাধা নেই। খোকসা ঘাঘট এখন অনেকটা অভিভাবকহীন।
মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী নদী কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালীন একবারও খোকসা ঘাঘট নদীর খবর নেওয়া হয়নি। চিত্রলেখা নাজনীন রংপুরের জেলা প্রশাসক থাকাকালীনও নদীর অবশিষ্ট স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বর্তমান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান চেষ্টা করছেন বলে জেনেছি। কিন্তু সৌন্দর্যবর্ধনের টাকা ফেরত গেলে তার দায় জেলা প্রশাসন এড়াতে পারবে কি? বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু করার তাগিদ দিয়েছেন।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারাইন পিপল ক্লাব, গ্রিন ইকো, গ্রিন ভয়েস, টঙের গান এবং গুনগুন নামক সংগঠন সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ শুরু করার দাবিতে মানববন্ধন করেছে। যেহেতু ঠিকাদার নিয়োগ করা আছে, নকশাও অনুমোদিত এবং কাজ শুরু করতে কোনো বাধা নেই—সেহেতু চাইলে এখনই সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা সম্ভব।
চলতি অর্থবছরের মধ্যে কাজ করা না হলে এ টাকা ফেরত যাবে। যাদের কারণে টাকা ফেরত যাচ্ছে, অনুসন্ধান করলে তাদের অযোগ্যতা কিংবা ব্যক্তিগত লাভালাভের কোনো বিষয় উঠে আসবে বলে আমরা মনে করি।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এই নদের পাশেই অবস্থিত। এ নদ হতে পারে নগরবাসীর জন্য বিনোদনের অনন্য স্থান। দখলমুক্ত করে নদটির দুই পাড় যদি সাজানো যায়, তাহলে পুরো রংপুরের মানুষ এ নদীর পাড়ে বিকেল-সন্ধ্যা কিংবা ছুটির দিন কাটাতে আসবেন। অসুন্দর নগরে সামান্য সৌন্দর্যও কি বৃদ্ধি পাবে না?
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক