মশার বংশবৃদ্ধি আর চাল-চিনির মূল্যবৃদ্ধি এক জিনিস নয়। দুইয়ের মধ্যে তফাত আছে। ফ্যামিলি প্ল্যানিং ছাড়াই ওষুধপত্তর দিয়ে মশার বংশবৃদ্ধি ঠেকানো যায়। কিন্তু নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানোর মতো ওষুধ দেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না।
চাল-তেল-নুন-আটা-আদা-চিনি নিয়ে ফি মাসেই একটানা একটা না একটা নাটক হচ্ছে। কোনো মাসে জেলের দামে তেল বিক্রি হচ্ছে। কোনো মাসে পেঁয়াজের আজেবাজে ঝাঁজে কপালের মাঝে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। কোনো মাসে মরিচের বেতাল ঝালের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে গেরস্তের গায়ের খাল খুলে যাচ্ছে। কোনো মাসে নুন নিয়ে নিমকহারামি নাটক হচ্ছে।
মূল্যবৃদ্ধিসংক্রান্ত সিরিয়ালধর্মী নাটকের সর্বশেষ যে এপিসোড এখন চলছে, তার নাম দেওয়া যেতে পারে ‘চিনি নিয়ে ছিনিমিনি’; অভিনয়ে বরাবরের মতো শ্রেষ্ঠাংশে আছেন ‘সে-তারা-তিনি’। তবে এই ‘সে-তারা-তিনি’দের চিনি চিনি করেও চেনা হচ্ছে না।
অন্যদিকে দামের বাড়াবাড়িতে চিনি যতটুকু দরকার, ততটুকু অনেকেরই পক্ষে কিনি কিনি করে কেনা হচ্ছে না। চিনির দাম কেজিপ্রতি দেড় শ টাকায় গড়ানোয় এরই মধ্যে রসগোল্লার রস আর জিলাপির প্যাঁচের পরিমাণ কমেছে; মিষ্টি পানতোয়ায় পানসে ভাব এসেছে; চায়ের দোকানে ডায়াবেটিক কাস্টমারদের কদর বেড়েছে; বিস্কুট-কেকে স্যাকারিনের ব্যবহার বেড়েছে।
অথচ দুয়ারে ঈদ। হাঘরে-হাভাতে গরিব-গুর্বারও অন্তত এই একটা দিন সেমাই-পায়েস খাওয়ার এবং খাওয়ানোর খায়েশ হয়। অন্তত এই দিনটায় গরুর মাংসের পাশাপাশি একটু জর্দা কিংবা ফিরনি রান্না করতে মনে চায়। সেই চাওয়াকে পাওয়ায় রূপ দেওয়ার জন্য দরকারি পাওয়ার কমিয়ে দিয়েছে এই সরকারি ‘চিনি নিয়ে ছিনিমিনি’। এই অবস্থায় সস্তায় কেউ যদি ‘তেঁতুলের পায়েস’ কিংবা ‘ঝালের সেমাই’ টাইপের হালের রেসিপি বাতলে দিতেন, তাহলে চিনির ওপর চাপ কমত।
খবরের কাগজে দেখলাম, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) নামের যে কমিশন আছে, তারা আমদানি খরচ, শুল্ক, পরিবহনসহ সব ধরনের খরচের পর ব্যবসায়ীদের লাভ কত দাঁড়াবে—সবকিছু হিসাব–নিকাশ করে ঠিক করে দিয়েছিল, খুচরায় প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১২৫ টাকা ও খোলা চিনির দাম ১২০ টাকায় বিক্রি করতে হবে। কিন্তু যথারীতি ‘কেউ কথা রাখেনি’।
বাজারে চিনির দাম এখন দেড় শ টাকা কিলো। কিন্তু খাতাপত্রে ১২৫ টাকা। কেউ বলতেই পারেন, কত কিছুরই তো দাম বেড়েছে। চিনির দামে ২৫ টাকা বেশি, এটা এমন আর কী! ঠিক এই লাস্যময়ী ভাষ্যটিই দাঁড় করাতে চান ব্যবসায়ীরা। পাবলিক যত বলবে, ‘এমন আর কী!’, তত লঘু হবে তাদের ‘২৫ টাকার ফাঁকি’। কেজিতে সরকারের ধরে দেওয়া দামের চেয়ে ২৫ টাকা করে বেশি নিলে এক শ কিংবা এক হাজার মেট্রিক টনে কত দাঁড়ায়, সে হিসাব করার সময় সম্ভবত সরকারের হাতে নেই।
বিটিটিসি বলেছে, ঈদের পর দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বোঝা যাচ্ছে, বাড়তি দাম মেটানোর বাড়তি রোজগার সৃষ্টি করতে না পারায় অনেকের বাজারের লিস্টি থেকে চিনি কিংবা মিষ্টি বাদ পড়তে যাচ্ছে। তার মানে, সামনের দিনগুলোতে চিনি ছাড়া পায়েস, পুডিং, মিষ্টি, জর্দা, ইত্যাদি রান্নার বিস্ময়কর রেসিপি আসতে যাচ্ছে।
এখন মিলমালিকেরা ফিল করছেন, এই দামেও তাঁদের পোষাচ্ছে না। তাঁরা নতুন আবদার তুলে বলছেন, সরকারিভাবে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনির দাম ১৫০ টাকা আর খোলা চিনি ১৪০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে। অথচ এই দামেই এখন তঁারা বাজারে বিক্রি করছেন। তার মানে বোঝা যাচ্ছে, সরকার যখন চিনির দাম ১২৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করবে, তখন তাঁরা সেই চিনি হয়তো ১৭৫ বা ১৮০ টাকায় বিক্রি করা শুরু করবেন। অর্থাৎ, সময়ের চেয়ে একটু এগিয়ে থাকা আরকি!
বিটিটিসি বলেছে, ঈদের পর দাম বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। বোঝা যাচ্ছে, বাড়তি দাম মেটানোর বাড়তি রোজগার সৃষ্টি করতে না পারায় অনেকের বাজারের লিস্টি থেকে চিনি কিংবা মিষ্টি বাদ পড়তে যাচ্ছে। তার মানে, সামনের দিনগুলোতে চিনি ছাড়া পায়েস, পুডিং, মিষ্টি, জর্দা, ইত্যাদি রান্নার বিস্ময়কর রেসিপি আসতে যাচ্ছে।
বিরাট খবর হলো, ইতিমধ্যে সরকারের ঠিক করে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে চিনি বিক্রি করা হচ্ছে কি না, তা নজরদারিতে রাখার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে খুব কড়া নির্দেশ দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সমস্যা হলো, সম্ভবত সেই নজরদারি করা লোকজনকেও সরকারের ১২৫ টাকা বেঁধে দেওয়া চিনি দেড় শ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক এই ‘চিনি নিয়ে ছিনিমিনি’ নাটকে তাঁদেরও অভিনয় করতে হচ্ছে। এই লুটপাটের মতো অপরাধে তারাও ‘ইনোসেন্টলি’ অংশ নিচ্ছে।
২.
দাঙ্গার সময় মাজার থেকে বাজারের লুটপাট হওয়া মালামাল উদ্ধারে জান বাজি রেখে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। ঘরে ঘরে তল্লাশি হচ্ছে।
পুলিশের ঠ্যাঙানি আর জেলে যাওয়ার ভয়ে লুটের মাল যে যেখানে পারছে, ফেলে দিয়ে আসছে। এক লোক মুদির দোকান থেকে দুই বস্তা চিনি লুট করে এনেছিল।
রাতের অন্ধকারে সে বস্তা দুটো কুয়োয় ফেলতে গেল। প্রথম বস্তা ভালোয় ভালোয় ফেলতে পারলেও দ্বিতীয়টি ফেলার সময় বস্তার সঙ্গে সে নিজেও পড়ে গেল। তাঁর চেঁচামেচি শুনে লোকজন জড়ো হলো। কুয়োয় দড়ি ফেলে লোকটাকে তোলা হলো।
কিন্তু ততক্ষণে যায় যায় অবস্থা। পানি খেয়ে তার পেট ফুলে গেছে। অনেক চেষ্টা চালিয়েও তাকে বাঁচানো গেল না। ঘণ্টাখানিকের মধ্যে সে মারা গেল। খানিক পরে লোকজন দড়ি বাঁধা বালতি কুয়োয় ফেলে পানি তুলে খেতে গিয়ে দেখল পানি শরবতের মতো মিষ্টি। লুটের চিনির কেরামতিকে সবাই মারা যাওয়া লুটকারীর কেরামতি বলে ধরে নিল। ওই রাতেই মৃত লোকটার কবরে প্রদীপ জ্বলল। দুই বস্তা চিনির কেরামতিতে এক রাতেই সাধারণ কবর হয়ে উঠল অসাধারণ মাজার।
চিনি নিয়ে অতি সম্প্রতি সাদাত হাসান মান্টোর ‘কেরামতি’ শিরোনামের এই গল্প পড়েছি। এই গল্পের মতো করে চিনি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ‘সে-তারা-তিনি’ পুলিশের অভিযানের মুখে ‘টুস করে’ কুয়োয় পড়ে যাক আর তাদের নামে চিনির বাজারে একটা করে মাজার বানানো হোক—এমন অশুভ কামনা না করেই বলি, তাদের সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক। ই–মেইল: