মানুষের মনের ভাব প্রকাশের সবচেয়ে বড় মাধ্যম হলো মুখের ভাষা অর্থাৎ কথা। কিন্তু সবাই কি মুখের ভাষা বা শব্দ ভাষায় কথা বলতে পারেন? মনে হয় পারেন না। কারণ, বেসরকারি জরিপে জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কানে শুনতে পায় না, কথাও বলতে পারে না। তাদের বলা হয় বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী। তাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হলো ইশারা ভাষা। সম্ভবত পৃথিবীতে মুখের ভাষা সৃষ্টির আগেই সৃষ্টি হয় ইশারা ভাষার। সারা বিশ্বের বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হলো এ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা। আমেরিকান এবং ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (এএসএল ও বিএসএল) কে মৌলিক ধরে বিভিন্ন দেশে সৃষ্টি হয়েছে আলাদা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা ইশারা ভাষা।
যেমন আমাদের দেশের বাক ও শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ বা বাংলা ইশারা ভাষায় মনের ভাব আদান–প্রদান করে থাকেন। যেহেতু আমরা ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম, তাই ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের একটা বড় প্রভাব রয়েছে বাংলা ইশারা ভাষার ওপর। এই বাংলায় প্রথম ১৯৬৩ সালে কয়েকজন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি গড়ে তোলেন (ডিপিও) ডিজঅ্যাবল পারসন অর্গানাইজেশন।
১৯৬৪ সালে ‘ইস্ট পাকিস্তান মূক-বধির সংঘ’ নামে পাকিস্তান সরকারের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে রেজিস্ট্রেশন লাভ করে সংগঠনটি। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৬ সালে নাম পরিবর্তন করে হয় ‘বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা’, যা সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সমাজসেবা অধিদপ্তর জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এ ভাষা ও এই ভাষার মানুষদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ ভাষার সংরক্ষণের জন্য জাতীয় বিশেষ শিক্ষাকেন্দ্র, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বধির সংস্থা ১৯৯৪ সালে একটি ছবিসংবলিত ডিকশনারি প্রকাশ করেন। এর বাইরে একটি বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ডিজঅ্যাবিলিটি ইন ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ করেছেন ইশারা ভাষার ওপর। যদিও শিক্ষাদান ও প্রশিক্ষক তৈরিতে এ বইগুলোর শব্দ অনেক কম।
তবে অনেক ভালো খবরও আছে। এ ভাষার মানুষের কথা মাথায় রেখে সরকারি–বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে, যা কয়েক বছর আগেও দেখা যেত না। সম্প্রতি গ্রামীণফোন তাদের হেল্প লাইন চালু করেছে ইশারা ভাষায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ইশারা ভাষায় ধারণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিবন্ধী মানুষ ও ইশারা ভাষার প্রতি গভীর ভালোবাসা আছে এ কথা মানতেই হবে। কারণ, তিনি ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ৭ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলা ইশারা ভাষা দিবস’ ঘোষণা করেন। তিনি যখন মঞ্চে ওঠেন বক্তব্য দেওয়ার জন্য, একজন ইশারা ভাষার দোভাষী সঙ্গে নিয়ে ওঠেন যেন দেশপ্রধানের কথাশ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরাও বুঝতে পারেন। বাংলাদেশের কিছু টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ইশারা ভাষায় সংবাদ পরিবেশনসহ বিভিন্ন তথ্য প্রচার হয়ে আসছে বেশ কয়েক বছর ধরে। তবে ইশারায় সংবাদ বা তথ্য উপস্থাপকের বক্সটাকে মনিটরে এত বেশি ছোট করে দেখানো হয় যে তা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই কী বোঝানো হচ্ছে। এ ছোট্ট বক্সটাকে বড় করার কোনো সদিচ্ছা লক্ষ করা যায়নি প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল দেশ টেলিভিশন তাদের সম্প্রচারের শুরুর দিন থেকে ইশারা ভাষার সংবাদ উপস্থাপন করে এলেও বর্তমানে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এ খবর হতাশার।
তবে অনেক ভালো খবরও আছে। এ ভাষার মানুষের কথা মাথায় রেখে সরকারি–বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে, যা কয়েক বছর আগেও দেখা যেত না। সম্প্রতি গ্রামীণফোন তাদের হেল্প লাইন চালু করেছে ইশারা ভাষায়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ ইশারা ভাষায় ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা বাংলাদেশের শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংস্থাগুলোর উন্নয়নে কাজ করছে। তাই আশা করি ভাষাগত পার্থক্যের কারণে শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা আর পিছিয়ে থাকবে না।
আহসান হাবিব সংবাদ উপস্থাপক (ইশারা ভাষা), বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং ইশারা ভাষা প্রশিক্ষক, হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনাল
ই–মেইল: [email protected]