তিনটা খবর পড়ে বিচলিত বোধ করছি।
১. দেশের ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় ৪১ শতাংশ গত বছর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার বাইরে ছিল। ওই সময় অর্থাৎ ২০২৩ সালে তারা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী হিসেবে ছিল না। মোট জনসংখ্যার হিসাবে শিক্ষার বাইরে থাকা শিশু ও তরুণের এই সংখ্যা ২ কোটি ৬২ লাখের বেশি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত রোববার বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর ফলাফল প্রকাশ করে। (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০২৪)
আপনি বলতে পারেন, ২৪ বছর পর্যন্ত লেখাপড়া করার দরকার তো সবার পড়ে না। মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাই অনেকের জন্য যথেষ্ট। উদ্বেগের বিষয় হলো ২০২০ সালে এই বয়সীদের ঝরে পড়ার হার ছিল ১ দশমিক ৭১, গত বছর তা বেড়ে হয়েছে ৯ দশমিক ৩৬। অর্থাৎ আমরা আমাদের ২০২০ সালের অর্জনের চেয়ে প্রায় ৬ গুণ পিছিয়েছি।
২. তৃতীয় শ্রেণির প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী বর্ণ (অক্ষর) ও শব্দ ঠিকঠাক চিনতে পারছে না। চতুর্থ শ্রেণির ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী সাধারণ শব্দ চিনতে পারে না। আর পড়ার (রিডিং) ক্ষেত্রেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে গলদঘর্ম হতে দেখা যায়। তৃতীয় শ্রেণির ৭৬ শতাংশ ও চতুর্থ শ্রেণির প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঠিকমতো বাংলা পড়তে পারছে না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএসের) এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। (প্রথম আলো, ২৫ মার্চ ২০২৪)
৩. চার বছরের ব্যবধানে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী কমেছে ১০ লাখের বেশি। (প্রথম আলো, ২৮ মার্চ, ২০২৪) যদিও এদের মধ্যে অনেকে কারিগরি, মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমে গেছে—তারপরেও সেই সংখ্যা ৪ লাখের বেশি নয়। মানে ৬ লাখ শিক্ষার্থী কমেছে মাধ্যমিক স্তরে।
সরকারি তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ৯৭ দশমিক ৯৭ ভাগ শিশু স্কুলে ভর্তি হয়। ২ ভাগ শিশু এমনিতেই ভর্তিই হয় না। তারপর ঝরে পড়ে প্রায় ১৩ শতাংশ। এখানে আমাদের উন্নতি আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক। ৮ জন শিশুর ১ জন প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করতে পারে না, এটা কি ভয়াবহ তথ্য নয়! পরিমাণগত দিক থেকেই এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। আর মানের দিক থেকে! তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ১০ জনের ৭ জনই ঠিকঠাক পড়তে পারে না—এই তথ্য জানার পর ভীষণ একটা ধাক্কা লাগে!
বিবিএসের জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫। এর মধ্যে কর্মজীবী শিশুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭। আর ৫ থেকে ১৩ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭, যা মোট শিশুর ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। আর ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন, যা মোট শিশুর ২ দশমিক ৭০ শতাংশ।(আজকের পত্রিকা ১৪ মার্চ ২০২৪) এই তথ্য জানার পর আমাদের গৌরবের বেলুনে আলপিন পড়ে না? এটা কীভাবে সম্ভব হবে যে ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা শিশুশ্রম নিরসন করব, শিশুশ্রমিকের সংখ্যা শূন্যে নিয়ে আসব।
নেটফ্লিক্সে একটা ডকুমেন্টারি সিরিজ টেলস বাই লাইট দেখলে বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। এই সিরিজের প্রথম পর্ব শুরুই হয় বাংলাদেশের শিশুদের হাল নিয়ে। ঢাকার শিশুরা কাজ করছে বেলুন বানানোর কারখানায়। অ্যালুমিনিয়ামের বাটি, গ্লাস বানানোর কারখানায়। খালি হাত দিয়ে গরম ঘুরন্ত চাকায় ধরে ধরে তারা তৈজস বানাচ্ছে। তারা চলে যাচ্ছে শহরের আস্তাকুঁড়ে। সেই ময়লার পাহাড়ে উঠে তারা প্লাস্টিকের বোতল ইত্যাদি কুড়াচ্ছে। নেটফ্লিক্সের সিরিজটা দেখলে ঘুম হারাম হয়ে যায়।
আমাদের ঘরে ঘরে শিশুশ্রমিকেরা কাজ করছে। টেম্পোর পেছনে ঝোলে শিশুরা। ঈদের বাজারে যান, দেখবেন কাপড়ের দোকানে আছে কতগুলো শিশু, এদের রাখা হয় ছাদের ওপরের দুই ফুট পরিসরের স্টোর থেকে মালামাল নামানোর জন্য। বইমেলায় দেখা পাই ফুল বিক্রেতা শিশুদের। একটা শিশু বাদাম বিক্রি করছিল ধানমন্ডি লেকের ধারে। তাকে বললাম, স্কুলে যাও, বাদাম কেন বিক্রি করো। সে বলেছিল, বাদাম বিক্রি করে তার দিনে ৩০০ টাকা আয় হয়, ম্যাট্রিক পাস করে কি সে দিনে ৩০০ টাকা আয় করতে পারবে?
বাংলাদেশের লেখাপড়ার, শিশুদের অবস্থার যেসব তথ্য এই খবরগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে, তা কি আপনাকে একটুও পীড়া দেয় না? আপনার কি মনে হয় না, আপনি জনে জনে ডেকে বলেন, শিক্ষা খাতে গুরুত্ব দিন, বিনিয়োগ বাড়ান, নজরদারি বাড়ান, দক্ষতা বাড়ান, দুর্নীতি-অদক্ষতার অবসান ঘটান। পরিকল্পনাহীনতা, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাব দূর করুন। শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে তা বহুগুণে বর্ধিত হয়ে ফিরে আসবে। আমাদের আর মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিতে মগজগলা গরমে কাজ করার জন্য শ্রমিক পাঠাতে হবে না, আমরা দক্ষ ব্যবস্থাপক ও পেশাজীবী পাঠাতে পারব বিদেশে, দেশেও যে যা করবেন, তা করবেন আধুনিক পদ্ধতিতে। এমনিতেই দুনিয়া থেকে কায়িক শ্রম উঠে যাবে, রোবট আর এআই সব কাজ করে দেবে। সেখানে যন্ত্রের কাজে সেই মানুষ হেরে যাবে, যে যন্ত্রের ওপরে প্রযুক্তির ওপরে দখল নিতে পারবে না। আর আমরা ৩০ লাখ শিশুকে নিয়োজিত রেখেছি শ্রমে। আমাদের ২ কোটি ৬২ লাখ মানুষ ২৪ বছরের আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ছে!
নীতিনির্ধারকদের বলি:
১. দেশের সব শিশুকে বিদ্যালয়ে নেওয়া নিশ্চিত করুন। প্রতিবন্ধী শিশু, প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকার শিশুও যেন বাদ না পড়ে।
২. সব শিক্ষার্থী যেন মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে তা নিশ্চিত করুন।
৩. বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেন শেখে। একজন শিক্ষার্থী যদি পড়তে শেখে, লিখতে শেখে, হিসাব কষতে শেখে, কথা বলায় পারঙ্গম হয় এবং কম্পিউটার চালাতে জানে, স্মার্টফোন চালাতে জানে, তাহলে সে তার নিজের অমিত সম্ভাবনাকে আপন শক্তিতেই কাজে লাগাতে পারবে, সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, দেশ ও সভ্যতাকে অনেক কিছু দিতে পারবে। এখন তৃতীয় শ্রেণি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পরেও শিক্ষার্থীরা যদি রিডিং পড়তেই না পারে, তাহলে বুঝতে হবে, আমরা ঘন তিমিরে আটকা পড়ে আছি। তার মানে আমরা চাই মানসম্মত শিক্ষা।
৪. শিক্ষকের সংখ্যা যেন পর্যাপ্ত হয়। তাঁরা যেন ঠিকমতো নিয়োগ পান, দুর্নীতি যেন না থাকে। তাঁরা যেন ঠিকমতো বেতন–ভাতা পান। তাঁরা যেন যোগ্য ও প্রশিক্ষিত হন।
৫. স্কুলগুলো যেন সুসজ্জিত হয়। শিক্ষা উপকরণ, কম্পিউটার থেকে শুরু করে শৌচাগার পর্যন্ত যেন ভালো থাকে।
৬. স্কুলে শিশুদের আকর্ষণ করার জন্য প্রণোদনা চাই। শিশুদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি চাই। আর চাই সর্বজনীন মিডডে মিল। দুপুরের খাবার। দুপুরের খাবার দিলে সেই স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনেক বাড়ে, অনুপস্থিতি কমে শূন্যের কোঠায় আসে, প্রথম আলোয় প্রকাশিত সরেজমিন প্রতিবেদনে আমরা তা দেখেছি।
৭. শিশুশ্রম শূন্যের কোঠায় আনতে হবে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ওপরে সর্বশক্তি নিয়োগ করুন। সব শিশু মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার আওতায় যেন আসে, আর ১০ বছর পর যেন সে মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই বের হয়।
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক