ভাষণ দিয়ে রেকর্ড গড়লেও যুক্তরাষ্ট্রে নেতানিয়াহুর দিন শেষ

মার্কিন কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে বক্তব্য দিচ্ছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুছবি : এএফপি

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ওয়াশিংটন অথবা হোয়াইট হাউসের কাছে আগন্তুক কেউ নন। গত বুধবার কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন। দুই দশকের মধ্যে এটা তাঁর চতুর্থবারের ভাষণ। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের রেকর্ড ভাঙলেন।

চার্চিল কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে তিনবার ভাষণ দিয়েছেন। এটা একটা সম্মান, যেটা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ইতিহাসে ঠাঁই করে নেবে। নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কলাকৌশল ভালো করেই বোঝেন, তিনি জানেন প্রধান দুটি দলকে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।

নেতানিয়াহু একজন আবেগপ্রবণ ও ক্যারিশম্যাটিক বক্তা।

সর্বশেষ ২০১৫ সালের মার্চ মাসে নেতানিয়াহুকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য শেষে ২৮ জন আইনপ্রণেতা দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে বক্তৃতার সময় উঠে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেওয়া আইনপ্রণেতার সংখ্যা ছিল একজন বেশি।

আরও পড়ুন

২০১৫ সালে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে তিরস্কার করেছিলেন। ইরানের সঙ্গে আসন্ন পারমাণবিক চুক্তি বিষয়ে তিনি বিস্ফোরক মন্তব্যে বলেছিলেন, ‘খুব খারাপ চুক্তি’। ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে নেতানিয়াহুর ক্রমবর্ধমান উত্তেজনায় ৩০ জন আইনপ্রণেতা নেতানিয়াহুর বক্তব্য বর্জন করেছিলেন।

এবার বিতর্কটা আরও গভীর। নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খাদের কিনারে নিয়ে এসেছেন। গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে বাধা দিয়ে, নির্বিচার মারণাস্ত্রের ব্যবহার করে, ২০ লাখের বেশি ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর কাছে জরুরি খাদ্যসহায়তা পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে নেতানিয়াহু সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে নিয়ে আসেন যে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য অস্ত্র চালান স্থগিত করে।

দুই নেতার মধ্যে সম্পর্কে ফাটল, ওয়াশিংটনে দুই দলের মধ্যে তীব্র ঝগড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন—এ সবকিছুর মধ্যেও রিপাবলিকান পার্টির প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে কংগ্রেসের সামনে ভাষণ দিতে আমন্ত্রণ জানান।

ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন নেতানিয়াহু। এটা তাঁর মধ্যে এতটা অহম ও অন্ধত্বের জন্ম দিয়েছে যে তিনি বিশ্বে ইসরায়েলের ভাবমূর্তিকে ধসিয়ে দিয়েছেন। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে তিনি তাঁর প্রভাব দিয়ে ইসরায়েল ও তাঁর নিজের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসতে পারেন।

নেতানিয়াহু তাঁর সেই পূর্বনির্ধারিত বক্তৃতা দিতে এক মাস দেরি করেন। দেশের ভেতরে তাঁকে রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলি তাঁর সেনাবাহিনী বিপাকে পড়েছে এবং উত্তর দিকের সীমান্তে দুঃসাহসী হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে উঠছে না। ১৫০ জনের বেশি ইসরায়েলি জিম্মির পরিবার নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকারের ওপর যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে এবং জিম্মিদের মুক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।

এটা নেতানিয়াহুর জন্য অভিশাপের মতো একটা ব্যাপার। কারণ, যুদ্ধবিরতি মানেই হলো ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত নেতানিয়াহু কতটা বিপর্যয় ঘটিয়েছেন, তার তদন্ত শুরু হওয়া, যেটা নিশ্চিতভাবেই তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ করে দেবে।

নেতানিয়াহুর প্রতি জনগণের সমর্থন পড়ে গেছে, তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এখন ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত। তাঁর উগ্র ডানপন্থী মিত্ররা যেকোনো ধরনের জিম্মি মুক্তি চুক্তির বিরোধী। তারা এই হুমকি দিয়েছে যে নেতানিয়াহু যদি কোনো ধরনের ছাড় দেন, তাহলে তারা তাকে ছেড়ে যাবে এবং জোট ভেঙে দেবে। বাইডেন প্রশাসনের নীতির বাইরে গিয়ে এই উগ্র ডানেরা লেবাননের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ চায়। অথচ তারা ভালো করেই জানে, এ ধরনের যুদ্ধের মানে হচ্ছে ইরানের সঙ্গে আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা।

আরও পড়ুন

নেতানিয়াহুর ওয়াশিংটন ভ্রমণ অবশ্যই অতি প্রয়োজনীয় হিসেবে চিহ্নিত হবে। ইসরায়েলের আইনসভা নেসেটের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে নেতানিয়াহু অনেক বেশি জনপ্রিয়।

ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন নেতানিয়াহু। এটা তাঁর মধ্যে এতটা অহম ও অন্ধত্বের জন্ম দিয়েছে যে তিনি বিশ্বে ইসরায়েলের ভাবমূর্তিকে ধসিয়ে দিয়েছেন। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে তিনি তাঁর প্রভাব দিয়ে ইসরায়েল ও তাঁর নিজের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসতে পারেন।

গত রোববার হঠাৎ প্রেসিডেন্ট প্রার্থী না হওয়ার ঘোষণা দেন জো বাইডেন। এর আগপর্যন্ত ইসরায়েলের বুদ্ধিজীবীরা বিশ্বাস করতেন, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন আর নেতানিয়াহু রিপাবলিকানদের কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবেন।

কিন্তু বাইডেনের আকস্মিক ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দিল। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি আচরণের কঠোর সমালোচক, তিনি এখন ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। ফলে ট্রাম্পের ভূমিধস বিজয়ের সম্ভাবনা কমে গেছে।

এখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাভাবিক সময় যাচ্ছে না। ডেমোক্রেটিক পার্টির আইনপ্রণেতাদের অনেকে তাঁর ভাষণ বর্জন করেন। ক্যাপিটল হিলের বাইরে হাজার হাজার প্রতিবাদকারী যুদ্ধাপরাধের দায়ে নেতানিয়াহুর বিচার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের সঙ্গে ইহুদিরাও ছিলেন।

আত্মগরিমার ওপর গড়ে ওঠা নেতানিয়াহুর রাজনীতি শুধু ইসরায়েলি রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেয়নি, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল বিশেষ সম্পর্কের ভিতটাকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। নেতানিয়াহু ওয়াশিংটনে অজনপ্রিয় হয়ে গেছেন, কংগ্রেসে পঞ্চমবার ভাষণ দেওয়ার সম্ভাবনা তাঁর আর নেই।

  • ওসামা-আল-শরিফ জর্ডানের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার