যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিতে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কে নানা সংযোজন-বিয়োজন ঘটেছে। এখনো এই ধারা অব্যাহত। এর মধ্যে ভারত রাশিয়া এবং ইউক্রেনপন্থী পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে একটি কৌশলগত অবস্থান বেছে নিয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশগুলো মস্কোর ওপর একচেটিয়া নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এর অংশ হিসেবে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে তেলের দামও বেঁধে দেয়। উদ্দেশ্য ছিল রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে আঘাত করা এবং একই সঙ্গে বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা।
রাশিয়ার সস্তা এই তেল ভারতসহ নতুন বাজার খুঁজে পায়। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির হিসেবে ভারত এখন প্রতিদিন রাশিয়া থেকে বিশ লাখ ব্যারেল তেল কিনছে। দেশটি যে পরিমাণ তেল আমদানি করছে, তার ৪৫ শতাংশেরই জোগান দিচ্ছে রাশিয়া।
এই তেল শুধু ভারতের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়নি, রাশিয়ার সস্তা তেল ভারতকে লাভজনক ব্যবসার পথ খুঁজে দিয়েছে। অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে ভারত অন্যান্য অঞ্চলেও রপ্তানি করছে। যে দেশগুলোয় হঠাৎ করে জ্বালানির প্রয়োজন পড়ছে তারাই মূলত ভারতের কাছ থেকে এই তেল কিনছে। ক্রেতাদের তালিকায় আছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। যদিও ইইউ সরাসরি রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ রেখেছে। অন্য দিকে সমুদ্রপথে রাশিয়া যত তেল রপ্তানি করে বছর খানিকের মাথায় ভারত তার প্রায় অর্ধেকের ক্রেতা হয়ে গেছে। অথচ আগে ভারত রাশিয়া থেকে দৈবাৎ তেল কিনত।
রাশিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। এই তেলের কিছু অংশ তারা পাইপলাইনে রপ্তানি করে থাকে। প্রচুর বিনিয়োগ ছাড়া এই পথের বিকল্প পাওয়া কঠিন। কিন্তু চীন ও ভারতে ট্যাংকারে করে রাশিয়া যে তেল পাঠায়, সেটির গতিপথ পরিবর্তন করা সম্ভব সহজেই। চীন ও ভারত গত মে তে সাগরপথে রাশিয়া যে অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে তার প্রায় ৮০ ভাগ কিনে নিয়েছে।
মস্কোও এখন ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল বিক্রি করত, তার চেয়ে বেশি বিক্রি করছে। কিন্তু কম দামে তেল বিক্রির মানে হলো রাশিয়া তার তেল বাণিজ্য থেকে যে আয় করে তার পরিমাণ কমে গেছে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ার পেছনে কারণগুলো জটিল। এটা কি পশ্চিমা দেশগুলোর দাম বেঁধে দেওয়ার কারণে, নাকি বিশ্ব বাজারে চাহিদা কমায় তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ যা-ই হোক, ভারত এ পরিস্থিতি থেকে ফায়দা ওঠানোর পথ করে নিয়েছে।
রাশিয়া থেকে আসা অপরিশোধিত তেল গুজরাটের জামনগর বন্দরে প্রথমে পৌঁছায়। সেখান থেকে পাইপে করে পৌঁছায় কাছের শোধনাগারে। জামনগরের এই শোধনাগারের মালিক রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ। এটি বিশ্বের বৃহত্তম তেল পরিশোধন কেন্দ্র যেখানে প্রতিদিন বারো লাখ ব্যারেল তেল পরিশোধন করা সম্ভব। রিলায়েন্সের নিয়ন্ত্রক ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এবং মোদি সরকারের কৌশলগত অংশীদার মুকেশ আম্বানী।
ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল শোধনাগার জামনগর থেকে দশমাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত। ভাদিনার কমপ্লেক্স নামে এই শোধনাগারটির মালিক নায়ারা এনার্জি। নায়ারার পঞ্চাশ শতাংশের মালিক রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান রোজনেফ্ট। অপর পঞ্চাশ শতাংশের মালিক একটি রুশ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান।
এ অঞ্চলে বাণিজ্যের প্রসার যেভাবে ঘটছে তাতে রাশিয়ার প্রতিষ্ঠানগুলো - আরেকটু এগিয়ে বলতে গেলে মস্কো - কিছুটা লাভবান হচ্ছে।
গত ডিসেম্বরে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, ‘ভারতের জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সবচেয়ে ভালো যা হবে তা করাই যৌক্তিক। যদি ভারতীয় জনগণকে গুরুত্ব দেওয়াকে আপনারা সমস্যা মনে করেন, তাহলে আমি দোষী।’
তেল শোধনাগারে যতটা পরিশোধন হচ্ছে তার কিছু অংশ ভারত দেশের ভেতরে ব্যবহার করছে। বাকিটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা এবং ক্রমশ আরও বেশি সংখ্যায় ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছে। ভারত এই তেল কিন্তু বাজারমূল্যে বিক্রি করছে। এতে করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো লাভবান হচ্ছে। ডলার ও ইউরো স্তূপ জমা হচ্ছে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
ফিনল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার গত এপ্রিলে ‘লন্ড্রোম্যাট’ দেশগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যেসব দেশ রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল কিনে ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ যারা রাশিয়া থেকে সরাসরি তেল কিনছে না তাদের কাছে পাঠায়, সেসব দেশকে বলা হয় লন্ড্রোম্যাট দেশ । এই দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ভারত, চীন, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সিঙ্গাপুর।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিক্কা বন্দর থেকে জামনগর শোধনাগারে তেল পাঠানো হয় । এই বন্দরটি সমুদ্রপথে রাশিয়া যত অপরিশোধিত তেল পাঠায় তার সবচেয়ে বড় অংশের গন্তব্য। আবার যেসব দেশ রাশিয়ার তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সেসব দেশে এই বন্দর থেকেই সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানি করা হয়। গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই শোধনাগার থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের পরিশোধিত তেল রাশিয়ার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা দেশগুলোতে পাঠানো হয়েছে।
ভারতের সমুদ্রগামী তেল কোথায় যায়
ভারত যুদ্ধকালীন নিষেধাজ্ঞা থেকে ফায়দা তোলার অভিযোগ অস্বীকার করেছে । সেপ্টেম্বরে ভারতে জি-টুয়েন্টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দেশটির কূটনীতিবিদেরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের উদ্বেগকে কি করে প্রশমন করবেন তা নিয়ে ব্যাপক কাজ করছেন।
তবে জনসংখ্যায় চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়া ভারতকে কি করে আরও স্বনির্ভর করা যায় মোদির চিন্তা কেবল সেদিকে। এর অর্থ অংশীদারদের অভিযোগকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের স্বার্থকে তিনি গুরুত্ব দিতে চান।
গত ডিসেম্বরে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল কেনার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেন, ‘ভারতের জনগণের স্বার্থ রক্ষায় সবচেয়ে ভালো যা হবে তা করাই যৌক্তিক। যদি ভারতীয় জনগণকে গুরুত্ব দেওয়াকে আপনারা সমস্যা মনে করেন, তাহলে আমি দোষী।’
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ।
লাজারো গ্যামিও, লিয়েন আব্রাহাম, আনা সোয়ানসন ও অ্যালেক্স ত্রাভেলি নিউইয়র্ক টাইমসের লেখক ও সাংবাদিক