স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিষয়টি ইতিমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত। দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক ভূকম্পন জরিপ থেকে শুরু করে গ্যাস অনুসন্ধান, কূপ খনন ও গ্যাস উত্তোলনের সব কাজ বাপেক্স দীর্ঘদিন ধরে সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে আসছে। এ ক্ষেত্রে বাপেক্সের সাফল্যের হারও বিদেশি কোম্পানির তুলনায় বেশি। বিদেশি কোম্পানিগুলো যেখানে প্রতি চারটি কূপ খননে একটি সাফল্য পেয়েছে, বাপেক্স সেখানে দুটির কম কূপ খননে একটি সাফল্য পেয়েছে এবং এ সাফল্য অর্জনের বেলায় অক্সিডেন্টাল ও নাইকোর মতো ‘উন্নত প্রযুক্তি’র বিদেশি কোম্পানিগুলোর মতো মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার ধাঁচে পরিবেশ ও সম্পদবিনাশী দুর্ঘটনাও ঘটায়নি।
প্রশ্ন হলো, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে বাপেক্সের দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও এবং এ কাজে বিদেশি কোম্পানির তুলনায় খরচ অনেক কম হলেও কেন স্থলভাগের গ্যাস উত্তোলনের কাজ বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া হচ্ছে?
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমকে স্থলভাগের গ্যাসকূপ খননের কাজ প্রথম দেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালে। দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের অধীন বিনা দরপত্রে ১০টি কূপ খননের জন্য গাজপ্রমের সঙ্গে চুক্তি করার কারণ হিসেবে গ্যাস-সংকট দ্রুত সমাধানের কথা বলা হয়েছিল। বাপেক্স যে কাজ স্বল্প খরচে করতে পারে, সে কাজই গাজপ্রমকে দিয়ে বাড়তি খরচে করানোর পেছনে বাপেক্সের ক্যাপাসিটি, অর্থাৎ একসঙ্গে অনেক কূপে কাজ করার ক্ষমতা না থাকার কথা বলা হয়েছিল।
এরপর ১১ বছর পার হয়ে গেছে, গাজপ্রমকে দিয়ে মোট ২০টি কূপ খনন করানো হয়েছে, কিন্তু এখনো বাপেক্সের সক্ষমতা না থাকার যুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের অধীন দরপত্র ছাড়া গাজপ্রমকে আরও পাঁচটি কূপ খননের কাজ দেওয়ার তৎপরতার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে। অথচ গাজপ্রম কর্তৃক ইতিপূর্বে কূপ খননের অভিজ্ঞতা আমলে নিলে বাপেক্সের বদলে গাজপ্রমকে কাজ দেওয়ার যৌক্তিকতা পাওয়া যায় না।
প্রথমত, বাপেক্সের তুলনায় গাজপ্রমের কূপ খনন ব্যয় অত্যধিক বেশি: একটি কূপ খননে বাপেক্সের যেখানে সর্বোচ্চ ৮০ কোটি টাকা খরচ হয়, গাজপ্রমকে সেখানে দিতে হয় ১৮০ কোটি টাকার বেশি।
দ্বিতীয়ত, গাজপ্রম মূলত তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন করে: কারিগরি সক্ষমতার কথা বলে গাজপ্রমকে অধিক অর্থ ব্যয়ে যে কাজ দেওয়া হয়, সে কাজগুলো গাজপ্রম নিজে সম্পন্ন করে না। সামগ্রিক কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে সম্পাদন করে, যেখানে গাজপ্রমের ভূমিকা স্রেফ সুপারভাইজরি। গাজপ্রম উজবেকিস্তানের এরিয়েল কে দিয়ে ড্রিলিং, স্লামবার্জার ও হ্যালিবার্টনকে দিয়ে সিমেন্টিং, লগিং, টেস্টিংসহ সব কাজ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন কন্ট্রাক্টরকে দিয়ে করিয়েছে। গাজপ্রম যেহেতু যন্ত্রপাতি ভাড়া করে কন্ট্রাক্টরকে দিয়েই কাজ করায়, তাহলে সেই কাজ প্রয়োজনে বাপেক্সই তো করতে পারে, কেন অযথা গাজপ্রমকে অধিক অর্থ দিয়ে কাজ করানো।
তৃতীয়ত, গাজপ্রমের কাজ কারিগরিভাবে ত্রুটিপূর্ণ: গাজপ্রম প্রথম পর্যায়ে যে ১০টি কূপ খনন করেছিল, সেগুলোর ৫টিই কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায়। ওই কূপগুলো আবার সংস্কার করে গ্যাস উত্তোলন করে বাপেক্স।
স্থলভাগে গ্যাস উত্তোলনে বাপেক্সের যে দক্ষতা ও বিদেশি কোম্পানির চেয়ে কয়েক গুণ কম খরচে কাজ করার যে উদাহরণ রয়েছে এবং জাতীয় সম্পদের মালিকানার প্রশ্নে সারা দেশে পিএসসি চুক্তির বিরুদ্ধে যে জনমত রয়েছে, তাতে স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্রে নতুন করে পিএসসি চুক্তির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। এ কারণে এখন বিদেশি কোম্পানিকে ভিন্ন ধরনের কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হচ্ছে, যেখানে গ্যাসকূপের নিয়ন্ত্রণ বাপেক্সের হাতে থাকলেও কূপ খননের বিনিময়ে বিপুল মুনাফা অর্জন করতে পারে গাজপ্রমের মতো বিদেশি কোম্পানি এবং তার যৌক্তিকীকরণের জন্যই বাপেক্সকে পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, এত কিছুর পরও বাপেক্সকে দিয়ে একসঙ্গে অনেক কূপে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের কাজ করানো হচ্ছে না কেন। কারণ হিসেবে বাপেক্সের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাবের কথা বলা হয়। কিন্তু গ্যাস উত্তোলনের জন্য প্রয়োজনীয় রিগ মেশিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাব তো সমাধান অযোগ্য কোনো চিরস্থায়ী সমস্যা নয়।
আর দেশে গ্যাসের সংকটও তো হঠাৎ তৈরি হয়নি। দিনে দিনে দেশে গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পর্যাপ্ত অনুসন্ধান ও উত্তোলন না হওয়ায় সংকটও বেড়েছে। তাহলে দিনে দিনে বাপেক্সের ক্যাপাসিটি, যন্ত্রপাতি ও লোকবল চাহিদা অনুযায়ী বাড়ানো হলো না কেন কিংবা এখনো কেন ক্যাপাসিটি আরও বাড়ানোর উদ্যোগ না নিয়ে বিদেশি কোম্পানির পেছনে ছোটা হচ্ছে? নিজস্ব সক্ষমতা না বাড়ানো হলে তো চিরকালই পরনির্ভরশীল থাকতে হবে।
বাপেক্সর সবচেয়ে বড় সংকট হলো গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান নিয়ে অনিশ্চয়তা। স্বতন্ত্র কোম্পানি হিসেবে যাত্রার শুরু থেকেই এর আর্থিক দিকগুলো যেমন তার আয়, তার স্থায়ী খরচ, অনুসন্ধান ও খনন খরচ—সবকিছুকেই অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে। একেকটা প্রকল্পের জন্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পেতে দীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে বাপেক্সের কাজ হয়ে পড়ে বেশ মন্থর।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ সাল থেকে গ্রাহকদের টাকায় তৈরি গ্যাস উন্নয়ন তহবিল (জিডিএফ) থেকে গ্যাস অনুসন্ধানে কিছু বরাদ্দ জুটলেও তা দিয়ে কেবল সীমিত পরিসরে কিছু অনুসন্ধানের কাজ করতে পেরেছে বাপেক্স, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে সক্ষমতা বাড়ানোর মতো অর্থ জোটেনি বাপেক্সের।
গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের সর্বশেষ ড্রিলিং রিগ বা খননযন্ত্রটি কেনা হয়েছিল ২০১২ সালে, এর পর থেকে সরকারি কোনো অর্থায়ন আসেনি বাপেক্সের প্রকল্পে। ফলে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসির যেখানে ১৫০টি ড্রিলিং রিগ রয়েছে, বাপেক্সের সেখানে আছে মাত্র ৬টি, যার মধ্যে দুটি নষ্ট এবং দুটি দিয়ে কেবল পুরোনো কূপ সংস্কার বা ওয়ার্কওভারের কাজ করা যায়।
ফলে কার্যত গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের ড্রিলিং রিগ রয়েছে মাত্র দুটি, যা দিয়ে বছরে সর্বোচ্চ তিনটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা সম্ভব। নতুন রিগ কেনা তো দূরের কথা, এমনকি পুরোনো রিগগুলো মেরামতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য নেওয়া মাত্র ২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ২০২১ সালের জুলাই থেকে ঝুলে আছে এলসি খোলার জন্য প্রয়োজনীয় ডলার বরাদ্দের অভাবে।
কিন্তু দেশের গ্যাস-সংকট ও গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, নতুন নতুন ড্রিলিং রিগ ও লোকবল নিয়োগের জন্য নিয়মিত বিনিয়োগ করা হতো, তাহলে কি বাপেক্সের এই সক্ষমতার সংকট থাকত? এমনকি ২০১২ সালে গাজপ্রমকে যখন প্রথম কাজ দেওয়া হয়, তখন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তো এত দিনে পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও লোকবল নিয়োগ দিয়ে সক্ষমতা বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হতো।
কিন্তু সময় মতো বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ তো নেওয়া হয়ইনি, বরং গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থও এলএনজি আমদানির কাজে ব্যয় করা হয়েছে। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার ব্যাংক হিসাবের উদ্বৃত্ত অর্থ হিসাবে এই তহবিলের তিন হাজার কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ে নেওয়ায় জিডিএফ থেকেও আর বরাদ্দ পাচ্ছে না বাপেক্স।
২০১২ সালে ড্রিলিং রিগ কিনতে খরচ হয়েছিল ২৫০ কোটি টাকা। এরপর আর ড্রিলিং রিগ কিনতে কোনো অর্থ বিনিয়োগ করেনি সরকার। বর্তমানে একটি ড্রিলিং রিগ কিনতে ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা খরচ হতে পারে। ড্রিলিং রিগ কিনতে সরকার গত ১০ বছরে এই সামান্য কয়েক শ কোটি টাকা বিনিয়োগ না করলেও ২০১৮-১৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করতেই ব্যয় করেছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থের একটা ক্ষুদ্র অংশও যদি বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে নিয়মিত ব্যয় করা হতো, তাহলে কি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হতো, তা বোঝা যায় বণিক বার্তায় প্রকাশিত এই সংবাদ থেকে: গ্যাস-সংকট তীব্র হওয়ার পর ২০২২ সালে ৮১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ৭২৩ বিসিএফ (বিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করেছে বাপেক্স, যা এলএনজি আকারে আমদানি করতে হলে খরচ হতো ৯৬ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা!
পুঁজি ও প্রযুক্তির অভাবের কথা বলে নব্বইয়ের দশকে দেশের স্থলভাগের বেশ কতগুলো গ্যাসব্লক উৎপাদন অংশীদারত্ব (পিএসসি) চুক্তির মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়। ফলে বর্তমানে দেশের স্থলভাগ থেকে উত্তোলিত গ্যাসের ৬০ শতাংশ আসছে মার্কিন বহুজাতিক শেভরন পরিচালিত কূপ থেকে, যে গ্যাসের একটা অংশ পেট্রোবাংলার লাভের গ্যাস হলেও বাকি অংশ শেভরনের কাছ থেকে ডলারে কিনতে হচ্ছে। এ জন্য প্রতি মাসে শেভরনকে দিতে হয় পাঁচ কোটি ডলার, যা প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার সমান।
স্থলভাগে গ্যাস উত্তোলনে বাপেক্সের যে দক্ষতা ও বিদেশি কোম্পানির চেয়ে কয়েক গুণ কম খরচে কাজ করার যে উদাহরণ রয়েছে এবং জাতীয় সম্পদের মালিকানার প্রশ্নে সারা দেশে পিএসসি চুক্তির বিরুদ্ধে যে জনমত রয়েছে, তাতে স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্রে নতুন করে পিএসসি চুক্তির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। এ কারণে এখন বিদেশি কোম্পানিকে ভিন্ন ধরনের কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হচ্ছে, যেখানে গ্যাসকূপের নিয়ন্ত্রণ বাপেক্সের হাতে থাকলেও কূপ খননের বিনিময়ে বিপুল মুনাফা অর্জন করতে পারে গাজপ্রমের মতো বিদেশি কোম্পানি এবং তার যৌক্তিকীকরণের জন্যই বাপেক্সকে পরিকল্পিতভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।
কোনো সমস্যার কারণ ও সমাধান জানা থাকার পরও সমস্যা সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়ার অর্থ হলো সেই সমস্যা থেকে সুবিধা নেওয়া। বাপেক্সের সক্ষমতার বৃদ্ধির পেছনে অর্থ ব্যয় না করে গাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খনন কিংবা বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করা তারই দৃষ্টান্ত।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ।’
ই-মেইল: [email protected]