বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্য পড়ান, আমার এমন একজন শিক্ষক আমাকে তাঁর সঙ্গে সালমান রুশদির দেখা হওয়াবিষয়ক দুটি ঘটনার কথা বলেছিলেন।
আমার ওই শিক্ষকের সঙ্গে রুশদির প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে। ওই সময়, অর্থাৎ ১৯৮১ সালে রুশদির ব্লকবাস্টার উপন্যাস মিডনাইটস চিলড্রেন বুকার পুরস্কার জিতেছিল।
বইটি তখন ব্রিটেনে ১০ লাখের বেশি কপি বিক্রি হয়েছিল। ফলে তখন রুশদি বেশ খ্যাতিমান হয়ে উঠেছিলেন। আমার শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, সে সময় রুশদির সঙ্গে আলাপ করে তাঁকে তাঁর বেশ ভদ্র, বাকপটু ও আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল।
১৯৮৮ সালে রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর ইসলাম ধর্মের অবমাননা ইস্যুতে বিশ্বব্যাপী বিক্ষোভ হয় এবং ১৯৮৯ সালে ইরানের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি রুশদিকে মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে তাঁর মাথার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন।
ওই ঘটনার বেশ পরে আমার শিক্ষকের সঙ্গে রুশদির দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল।
হত্যার হুমকি মাথায় নিয়ে চলা এবং কয়েক বছর ধরে আত্মগোপনে থাকার অভিজ্ঞতা হয়তো রুশদিকে বদলে দিয়েছিল। বদলে যাওয়ার পেছনে সম্ভবত ফতোয়ার কারণে তাঁর বেড়ে যাওয়া সাহিত্যিক সুপারস্টার মর্যাদার বিষয়টিও কাজ করেছিল।
তবে কারণ যা-ই হোক, দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার পর আমার শিক্ষকের কাছে রুশদিকে অহংকারী, নির্লিপ্ত ও শীতল মেজাজের মনে হয়েছিল।
অর্থাৎ আমার শিক্ষকের ভাষ্যমতে, রুশদির কথাবার্তা ও চরিত্রে একটি রূপান্তর ঘটে গিয়েছিল। তাঁর সেই রূপান্তরের কথা আমাকে যে ইস্যুতে তাঁর আরেকটি রূপান্তরের বিষয় মনে করিয়ে দিয়েছে, সেটি হলো ফিলিস্তিন।
চলতি মে মাসে, জার্মান রেডিও রুন্ডফাঙ্ক বার্লিন-ব্র্যান্ডেনবার্গকে (আরবিবি) দেওয়া সাক্ষাৎকারে, রুশদি ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে পশ্চিমা বিশ্বে ছাত্ররা যে বিক্ষোভ করেছেন, তাকে ‘অনেক ক্ষেত্রে একটি ইহুদিবিদ্বেষী ভাষ্য’ বলে নিন্দা করেছেন। সেখানে তিনি ইসরায়েলি সংস্কৃতিকে বর্জন করার আহ্বানকে ‘একটি সর্বজনীন সমস্যা’ আখ্যা দিয়ে সেটিকে নিন্দার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
রুশদি বলেছেন, ‘গাজায় এখন যা ঘটছে, তা দেখে যেকোনো সাধারণ মানুষ হতবাক হতেই পারে; বিশেষ করে সেখানে যে সংখ্যক নিরপরাধ মানুষ নিহত হচ্ছে, তা দেখে যে কেউ ধাক্কা খেতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, বিক্ষোভকারীরা এসব হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে হামাসের কথাও উল্লেখ করতে পারত। কারণ, এই ঘটনার সূত্রপাত তারাই করেছে।’
রুশদি বলেছেন, ‘হামাস একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং মজার বিষয় হলো, একটি তরুণ প্রগতিশীল ছাত্রনীতি একটি ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সমর্থন করছে। তাঁরা ফ্যাসিবাদী কায়দায় “ফিলিস্তিন মুক্ত করো” বলে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করার দাবি করছে।’
রুশদি বলেছেন, ‘আমি আমার জীবনের বেশির ভাগ সময় একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ছিলাম। কিন্তু এখন মনে করি, ফিলিস্তিন যদি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তা হামাস দ্বারা পরিচালিত হবে এবং সেটি আমাদের কাছে একটি তালেবান নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্র হবে। তা হবে ইরানের একটি স্যাটেলাইট রাষ্ট্র। পশ্চিমা বামদের প্রগতিশীল আন্দোলন কি সেটাই তৈরি করতে চাইছে?’
এটা খুবই লজ্জার যে রুশদি তাঁর অসাধারণ কল্পনা দিয়ে এই ফিলিস্তিনি যুবকদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারেননি। তিনি তাঁর লেখকের কল্পনা দিয়ে স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ একটি মুক্ত ফিলিস্তিনের কল্পনাও করতে পারেন না। আফসোস, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। আর রুশদি এসব পশ্চিমা সরকারের চেয়েও পেছনে পড়ে আছেন।
রুশদির এসব কথাবার্তা পশ্চিমের ইসরায়েলপন্থী রাজনৈতিক অভিজাতদের ভাষ্যের সঙ্গে একেবারে সংগতিপূর্ণ ছিল (যেমন তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের দেশ জার্মানিতে ইসরায়েলপন্থী কথাবার্তা যতটা উচ্চারিত হয়, অন্য কোনো পশ্চিমা দেশে ততটা হয় না)।
নিজেদের পড়াশোনা ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের কথা না ভেবে পুলিশ ও ইসরায়েলপন্থী প্রতিপক্ষের সহিংসতার মুখে দাঁড়িয়ে যে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন, রুশদি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারতেন। তিনি ৭৬ বছরের ইসরায়েলি বর্ণবাদ, উপনিবেশ এবং ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের কথা বলতে পারতেন। এসব না বলে তিনি বললেন, গাজার এই তাণ্ডবের ‘সবকিছুর সূত্রপাত করেছিল’ ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলা।
রুশদি গাজায় ইসরায়েলের কার্পেট বোমা হামলা, গাজার মানুষের না খেয়ে মরা, ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা, সেখানকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করার বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কথা বলতে পারতেন।
কিন্তু তিনি সেসব কথার ধারেকাছে না গিয়ে সেসব ইসরায়েলি ফাঁকা কথাবার্তার প্রতিধ্বনি করে যাচ্ছিলেন, যার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো গাজা উপত্যকার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞকে ন্যায্যতা দেওয়া।
রুশদি বরাবরের মতো ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে এতটা খারিজি ভাবাপন্ন লোক ছিলেন না।
১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব কনটেমপোরারি আর্টসে (আইসিএ) রুশদির সঙ্গে ফিলিস্তিনি-আমেরিকান রাজনৈতিক কর্মী ও সাংস্কৃতিক সমালোচক অ্যাডওয়ার্ড ডব্লিউ সাইদের যে বাক্যবিনিময় হয়েছিল, তা বিশ শতকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উপভোগ্য সাক্ষাৎকার হিসেবে টিকে আছে।
এর কৃতিত্ব অবশ্য প্রধানত সাইদকে দেওয়া হয়েছিল, যিনি ওই সময় ফিলিস্তিনিদের বঞ্চনা নিয়ে তাঁর গীতিময় ও শক্তিশালী বই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই লিখেছিলেন। যথার্থ মূল্যায়নের মাধ্যমে রুশদি সে সময় বইটিকে ‘ভিটে হারানো, ভূমিহীনতা, নির্বাসন ও আত্মপরিচয়নির্ভর একটি আবেগময় ও চলমান আখ্যান’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি ইনস্টিটিউট অব কনটেমপোরারি আর্টসে (আইসিএ) রুশদি-সাইদের সেই সাক্ষাৎকারটি দেখানো হয়েছে। ১৯৮০-এর দশকের হাস্যকর ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডা যেভাবে সাইদ দেখিয়ে দিচ্ছিলেন, তা দেখে শ্রোতারা হেসেছিলেন এবং ভিডিওটির শেষে তাঁরা রুশদি ও সাইদ দুজনকেই সাধুবাদ জানিয়েছিলেন।
তবে দর্শকদের সেই সাধুবাদের মধ্যে ভারী দীর্ঘশ্বাসও ছিল। কারণ, সম্প্রতি সাক্ষাৎকারে রুশদি বলেছেন, ‘সমস্যা হয়েছে, ইহুদিবিদ্বেষ প্রকাশ না করে জায়নবাদের কোনো ধরনের সমালোচনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নিয়ে রুশদির নিজস্ব রাজনীতি অবশ্যই আছে। ফতোয়া-পরবর্তী বছরগুলোয় রুশদি তাঁর ইসলামবিদ্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদী অ্যাজেন্ডা নিয়ে পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের কাছে সেলিব্রিটিতে পরিণত হয়েছিলেন।
তিনি আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং সেসব নব্যরক্ষণশীল ও ডানপন্থী আন্দোলনকারীদের কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন, যাঁরা যুক্তি দিয়ে থাকেন, ইসলাম একটি হুমকি এবং পশ্চিমা সভ্যতাই হলো উচ্চতর সভ্যতা।
খোমেনির ফতোয়া প্রসঙ্গে যে বিষয়টি সব সময়ই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, তা হলো, ইসলামি বিশ্বের বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী রুশদির বাক্স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলেছিলেন এবং তাঁর জীবন রক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
‘ফর রুশদি: এসেজ বাই আরব অ্যান্ড মুসলিম রাইটার্স ইন ডিফেন্স অব ফ্রি স্পিচ’ শিরোনামে ১৯৯৪ সালে যে সংকলনগ্রন্থ বেরিয়েছিল, তাতে মাহমুদ দারবিশ, এমিল হাবিবি, সাইদসহ বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনির লেখা ছিল।
গাজার সাংবাদিক বিসান আওদা ও মোতাজ আজাইজা এবং পূর্ব জেরুজালেমের কবি মোহাম্মদ এল-কুর্দের মতো অনেক লেখক-বুদ্ধিজীবী আছেন, যাঁরা কখনোই নিজেকে তালেবান-সদৃশ রাষ্ট্রের সমর্থক নন। বরং তাঁরা সেই হতাশাগ্রস্ত ফিলিস্তিনি যুবকদের স্বপ্ন দেখান, যাঁরা তাঁদের এই ছোট্ট জীবনে দখল, বর্ণবাদ এবং গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই দেখেনি।
এটা খুবই লজ্জার যে রুশদি তাঁর অসাধারণ কল্পনা দিয়ে এই ফিলিস্তিনি যুবকদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারেননি। তিনি তাঁর লেখকের কল্পনা দিয়ে স্বাধীন, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ একটি মুক্ত ফিলিস্তিনের কল্পনাও করতে পারেন না।
আফসোস, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে ও স্পেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। আর রুশদি এসব পশ্চিমা সরকারের চেয়েও পেছনে পড়ে আছেন।
● গ্যাব্রিয়েল পোলি একজন ইতিহাসবিদ, লেখক এবং অধিকারকর্মী। তাঁর প্রথম বই প্যালেস্টাইন ইন দ্য ভিক্টোরিয়ান এজ ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ