যদি বলা হয় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী অসাধ্যসাধন করলেন, খুব একটা বাড়াবাড়ি বোধ হয় হবে না। প্রবল তুষারপাতের মধ্যে শ্রীনগরের শের-ই-কাশ্মীর স্টেডিয়ামে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র সমাপ্তি অনুষ্ঠানে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যা কবুল করেছেন কিংবা কংগ্রেসে রাহুলের ছায়া বলে পরিচিত কেরালার কে সি বেণুগোপালের সরল স্বীকারোক্তি বিশ্বাস করলে মানতেই হবে, রাহুল যা করলেন, তা অসাধ্যসাধনই।
দক্ষিণে কন্যাকুমারী থেকে উত্তরে শ্রীনগর পর্যন্ত চার হাজার কিলোমিটার পথ রাহুল হেঁটে পার হবেন—সেই বিশ্বাস প্রিয়াঙ্কা বা বেণুগোপালের ছিল না। শুরু থেকেই তাঁরা সংশয়ী ছিলেন। ভাবেননি রাহুল যাত্রা শেষ করতে পারবেন।
অনেকে ভেবেছিলেন, মাঝপথে হঠাৎ কোনো কারণ দেখিয়ে যাত্রা বন্ধ হলেও হতে পারে। কোভিডের দোহাই দিয়ে বিচলিত বিজেপিও সে চেষ্টা করেওছিল। পারেনি। প্রিয়াঙ্কা-বেণুগোপাল এ–ও ভাবেননি, এত বিপুল মানুষ এই যাত্রায় শামিল হবেন। ভারত জোড়ো যাত্রা আন্দোলনের রূপ নেবে। যাত্রা শেষে সংগত কারণে রাহুল তাই শ্লাঘা বোধ করছেন। অনেককে অনেক জবাবও তিনি দিতে পেরেছেন এই পাঁচ মাসে।
আত্মশ্লাঘার অন্য একটি কারণও আছে। রাহুলই একমাত্র রাজনীতিক, যিনি ধারাবাহিকভাবে নরেন্দ্র মোদির সরকারের বিরোধিতার পাশাপাশি ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’–এর সমালোচনা করে আসছেন। শিল্পপতি গৌতম আদানির উল্কাসম উত্থানের পেছনে তিনি মোদির আশীর্বাদী হাত দেখেছেন। বারবার এই সরকারকে ‘আদানি-আম্বানির সরকার’ বলে অভিহিত করেছেন।
গুটিকয় শিল্পপতির জন্য এই সরকার প্রাণপাত করে চলেছে—সেই প্রচার ধারাবাহিকভাবে করে গেছেন। বলেছেন, বিতর্কিত কৃষি আইনের পেছনেও ছিল আদানির মতো বৃহৎ পুঁজির আগ্রহ। প্রধানমন্ত্রীর সব দরদ শুধু বন্ধু শিল্পপতিদের জন্যই। সেই আদানির ‘জালিয়াতি’ ফাঁস করা হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন তাঁর অতিরিক্ত শ্লাঘার কারণ। ভারত জোড়ো যাত্রার সার্থক পরিসমাপ্তির সময় আদানির বিরুদ্ধে তাঁর এযাবৎ মেলে ধরা অভিযোগ এমন অভাবিত সমর্থন পাবে, তা নিশ্চিতই তিনি ভাবেননি। হিনডেনবার্গের গবেষণা তাই ‘ডাবল ধামাকা’ হিসেবে উপস্থিত। দ্বিগুণ তৃপ্তিদায়ক।
ভারত জোড়ো যাত্রা শুরুর আগে রাহুলের রাজনৈতিক পরিচিতি ছিল অনেক রকমের। দলের ‘জি-২৩’ গোষ্ঠীর কাছে তিনি ছিলেন চপলমতি। অস্থিরতার পরাকাষ্ঠা। এই আছেন তো এই নেই! বিজেপির চোখে তিনি ‘পার্টটাইম পলিটিশিয়ান’, ‘নন–সিরিয়াস’, ‘আর্ম চেয়ার রাজনীতিক’ এবং ‘পাপ্পু’। যাত্রা শেষে সবার ধারণা পাল্টে ও ভাবমূর্তি বদলে রাহুল বোঝালেন তিনি একাগ্র, দৃঢ়চেতা ও নির্ভীক। বিজেপির ‘ঘৃণা ও হিংসার’ রাজনীতির বিপ্রতীপে এক বিকল্প আখ্যান বা ‘ন্যারেটিভ’ তিনি দেশকে উপহার দিতে চাইছেন।
সেই রাজনীতির ভিতে আছে দেশের সংবিধান স্বীকৃত প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ববোধ, বৈষম্যহীনতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে একাত্মতাবোধের অনুভূতি। প্রকৃত গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদে যাঁরা বিশ্বাসী, ‘ঘৃণা ও হিংসার অসহ্য আবহে’ তাঁদের জোটবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা তিনি মেলে ধরতে চেয়েছেন। এই নব–আখ্যান মোদি সরকার ও বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার মতো মজবুত কি না, ‘বিভাজনের রাজনীতির’ বিরুদ্ধে সমভাবাপন্নদের একজোট করা যাবে কি না, তা আগামী দিনের দ্রষ্টব্য। রাহুল ও কংগ্রেসের চ্যালেঞ্জও সেটা।
রাহুলের নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি এই যাত্রা তাঁকে আমূল বদলে দিয়েছে। জনতার সঙ্গে তিনি মিশেছেন। জনতার কথা শুনেছেন। দুঃখ, বেদনা, চাহিদা, উপলব্ধির অংশীদার হয়েছেন। দেশের প্রকৃত সত্তার সন্ধান পেয়েছেন। মানুষের মন ও মানসিকতা বুঝতে শিখেছেন। বারবার বলেছেন, রাজনীতিক ও মানুষ হিসেবে এই যাত্রা তাঁকে ঋদ্ধ করেছে।
কংগ্রেস হারানো জমি কতটা ফেরত পাবে, কিংবা বিজেপির মুঠো আলগা হয় কি না, তা বোঝা যাবে আগামী মে মাসে কর্ণাটকের ভোটে। পরের পরীক্ষা বছর শেষে। তিন বড় রাজ্য রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশ এবং প্রত্যাশামতো ভোট হলে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ফল বুঝিয়ে দেবে রাজনীতির নব–আখ্যান গ্রহণীয়, না বর্জনীয়। ভোট-রাজনীতিতে ভারত জোড়ো যাত্রার সার্থকতাই–বা কতটুকু।
বিজেপি সেই সম্ভাবনার দিকেই আগ্রহী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তারা চারটি বিষয় নজরে রাখছে। প্রথমত, সাংগঠনিক ও মানসিক দিক থেকে কংগ্রেস কতটা উজ্জীবিত থাকে। দ্বিতীয়ত, রাজ্যে রাজ্যে, বিশেষ করে কর্ণাটক ও রাজস্থানের গোষ্ঠী কোন্দল তারা মেটাতে পারে কি না। তৃতীয়ত, বিজেপিবিরোধী ঐক্য স্থাপনে কংগ্রেস কতটা সফল হয়। চতুর্থত, বিরোধী জোটের রাশ কার হাতে থাকে।
এর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় আগ্রহ প্রধান। ভারত জোড়ো যাত্রার প্রকাশ্য সমালোচনা করেনি পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস, ওডিশায় বিজেডি, অন্ধ্র প্রদেশে ওয়াইএসআর কংগ্রেস ও টিডিপি, তেলেঙ্গানায় টিআরএস এবং উত্তর প্রদেশের এসপি, বিএসপি। এই দলগুলো কংগ্রেসের হাতে হাত না মেলালে ২০২৪ সালে বিজেপির বলিরেখা গাঢ় হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিজেপি তাই এখনো অবিচলিত।
যাত্রা তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। সেই সঙ্গে বাড়াতে পেরেছেন নিজের গ্রহণযোগ্যতা। দলে তো অবশ্যই, অন্য অনেকের কাছেও। এতকাল যাঁরা কংগ্রেসবিরোধী রাজনীতি করেছেন, নব আখ্যানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ‘ঘৃণার বাজারে ভালোবাসার দোকান খুলতে’ তাঁরাও যাত্রাসঙ্গী হয়েছেন। এই যাত্রা দলে রাহুলের অবস্থানও প্রশ্নাতীত করেছে। এ সত্ত্বেও বলতে হবে, বিকল্প আখ্যানের নেতৃত্বদানের প্রশ্নে এখনো তিনি অবিতর্কিত ও অবিসংবাদিত হয়ে উঠতে পারেননি। পারলে তুষারপাতের মধ্যেও শের-ই-কাশ্মীর স্টেডিয়াম গমগম করে উঠত আমন্ত্রিত সব বিরোধী নেতার উপস্থিতিতে।
এই যাত্রা কংগ্রেসের রাজনৈতিক মনোভাব ও অবস্থানেরও বদল ঘটিয়েছে। বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদের মোকাবিলায় কংগ্রেস কখনো নরম হিন্দুত্ব, কখনো নেহরুর আমলের সমাজতন্ত্র, কখনোবা ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঁকড়ে ধরেছিল। এ যাত্রা সেই অবস্থান বদলে প্রকৃত গণতন্ত্র, দেশপ্রেম, আইনের শাসন, নিরপেক্ষ সাংবিধানিক প্রাতিষ্ঠানিক মাধুর্য প্রতিষ্ঠা ও সর্বস্তরীয় বৈষম্যহীন ও ভেদাভেদমুক্ত সমাজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করাতে পেরেছে। সংখ্যাধিক্যের দোহাই দিয়ে একনায়কতন্ত্রের বিকাশ, ঘৃণা, হিংসা ও বিদ্বেষের বীজ ছড়ানো, সংবিধানের ওপরে সংসদকে প্রতিষ্ঠার ‘অপচেষ্টা’ নিয়ে বিতর্কে শামিল করাতে পেরেছে দেশবাসীকে।
কংগ্রেস হারানো জমি কতটা ফেরত পাবে, কিংবা বিজেপির মুঠো আলগা হয় কি না, তা বোঝা যাবে আগামী মে মাসে কর্ণাটকের ভোটে। পরের পরীক্ষা বছর শেষে। তিন বড় রাজ্য রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশ এবং প্রত্যাশামতো ভোট হলে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভার ফল বুঝিয়ে দেবে রাজনীতির নব–আখ্যান গ্রহণীয়, না বর্জনীয়। ভোট-রাজনীতিতে ভারত জোড়ো যাত্রার সার্থকতাই–বা কতটুকু।
বিজেপিকে বহু কদম এগিয়ে রেখেছেন নরেন্দ্র মোদি। শাসক হিসেবে তো বটেই, জনপ্রিয়তার নিরিখেও তাঁর মাথা সবার চেয়ে উঁচু। জনতার আস্থাও যে অটুট, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক জরিপ। মোদির তৈরি রাজনৈতিক ‘ন্যারেটিভ’ কতটা সফল, আট বছর ধরে বিধানসভা ও লোকসভা ভোটের ফল তা বোঝাচ্ছে।
ভারত জোড়ো যাত্রা সফল। কিন্তু রাজনীতির নব আখ্যান সফল করতে কংগ্রেসকে এখনো লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। রাহুল গান্ধীর বড় পরীক্ষা সেটাই।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি