সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এখন কূটনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলছে। যদিও বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থায় সৌদি আরবের কূটনৈতিক নীতির যে পরিবর্তন, তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা নেই। পশ্চিমের সঙ্গে সখ্য রেখে সৌদি আরব এখন প্রাচ্যে প্রভাব বাড়াতে চাইছে। গত কয়েক মাসে সৌদি আরবের কূটনৈতিক মানচিত্রের দিকে তাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
সৌদি আরবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ বরাবরই সম্মানজনক। বাদশাহ ফয়সাল দীর্ঘদিন এই মন্ত্রণালয় সামলেছেন। পরে তাঁর নেতৃত্বে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে প্রিন্স সৌদ বিন ফয়সাল পররাষ্ট্রনীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান এখন দায়িত্বে আছেন। উদ্যমী এই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্ব সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশলে বেশ সাহসী কিছু পরিবর্তন এনেছে। আরব বিশ্ব যেখানে কিছুটা ম্রিয়মাণ, সেখানে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা চীনা নেতৃত্বের সঙ্গে, কিংবা কায়রোয় নিজের দেশকে উপস্থাপন অথবা প্যারিসের এক্সপোতে গিয়ে সফল হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে সৌদি আরবের পুনর্জাগরণ দেশটির উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সৌদি সমাজ ও অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নিজেদের গুরুত্ববহ করে তোলার উদ্যোগ খুব পরিষ্কার। সৌদি আরব ক্রমে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সম্পদ ও ধর্মীয় কারণেই সৌদি আরবের অবস্থান এখন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কারণ, হোয়াইট হাউস প্রশাসনের নজর এখন চীন ও রাশিয়ার উত্থানের দিকে। এই সুযোগে সৌদি আরবও স্বতন্ত্র পথ খুঁজে নিয়েছে। প্রায় এক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সৌদি আরব থেকে চীনের তেল আমদানির পরিমাণ বেশি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সৌদি আরব ও চীন দ্রুত নিজেদের সম্পর্ককে ঝালিয়ে নেয়। যদিও জ্বালানি খাত থেকেই দেশ দুটির মধ্যে অংশীদারত্বের সূচনা, দ্রুতই তা আরও বিস্তৃত হয়।
চীন ব্যাপকভাবে সৌদি অর্থনীতিতে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। সৌদি আরবে ফাইভ জি নেটওয়ার্ক সুবিধা চালুতে হুয়াওয়েই ভূমিকা রেখেছে। সৌদি গ্রিনফিল্ড প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত মাসে দেশ দুটি সাত বিলিয়ন ডলার নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন করেছে। ২৬ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল বা ৫০ বিলিয়ন চীনা ইউয়ান বিনিময়ের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিস্তার ঘটেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আফ্রিকা ও আরবের কোনো স্থায়ী প্রতিনিধি নেই। গাজায় ইসরায়েল সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে আব্রাহাম অ্যাকর্ড থেকে বেরিয়ে আসায় সৌদি আরব প্রশংসিত হয়েছে। একই সঙ্গে সৌদি আরবে আরব, ইসলামিক ও আফ্রিকান সম্মেলন প্রমাণ করেছে, মুসলিম বিশ্বের একতাবদ্ধ হওয়া এখন কতটা প্রয়োজন। বিশেষ করে যখন কূটনৈতিক নীতি সংকটে পড়ে।
সৌদি আরব যখন ভূরাজনীতিতে ক্রমে স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, তখন চীন তার দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের দূতিয়ালিতে সৌদি আরব এখন ইরানের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে নিয়েছে। আবার ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের মধ্যে গত মাসে প্রিন্স ফয়সালসহ চারজন আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেইজিং সফর করেছেন। এই সফরের মধ্য দিয়ে সৌদি আরব এই বার্তা দিয়েছে যে তারা নতুন নতুন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী।
যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে সৌদি আরব একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপনে জোর দিচ্ছে। ভারতে জ্বালানি সরবরাহে সৌদি আরবের অবস্থান তৃতীয়। সেদিক থেকে দুই দেশের জন্যই দ্বিপক্ষীয় এই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ। ‘সৌদি-ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কাউন্সিল ২০১৯’ স্থাপনের পর ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দুবার ভারত সফরে গেছেন। গত সেপ্টেম্বরে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতেও ভারতে যান তিনি। সেখানেই ইন্ডিয়া-মিডল ইস্ট-ইউরোপ করিডরের ঘোষণা আছে। এই প্রকল্পের আওতায় মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারত ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার কথা।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি, খাদ্যনিরাপত্তা ও গ্রিড কানেকটিভিটিকে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরব। এর বাইরেও স্টার্টআপ, শিক্ষা, ডিজিটালাইজেশন, সমরাস্ত্র নির্মাণ, ভারতের পশ্চিমে পরিশোধন কেন্দ্র স্থাপনে সৌদি আরামকো বিনিয়োগ করেছে। সৌদি আরব এখন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বন্ডে তার সংরক্ষিত অর্থ ভাঙিয়ে ফেলছে। পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বাইরে গিয়ে তারা এখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী ।
সৌদি কূটনীতির পরিবর্তনের অন্যতম নির্দেশক হলো গত আগস্টে দেশটির ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেওয়া। আমরা জানি, ব্রিকসের সদস্য হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইরান, আর্জেন্টিনা ও ইথিওপিয়াকে যুক্ত করায় ব্রিকস এখন ৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে। আগামী তিন দশকে এই দেশগুলোয় সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হতে পারে। এই জোটে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সৌদি আরব বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে। একই সঙ্গে আরব বিশ্বে তাদের শক্তিমত্তারও জানান দিয়েছে।
এ তো গেল মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে সৌদি আরবের কূটনৈতিক তৎপরতার প্রসঙ্গ। আরব ও মুসলিম বিশ্বেও সৌদি আরব এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আফ্রিকা ও আরবের কোনো স্থায়ী প্রতিনিধি নেই। গাজায় ইসরায়েল সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে আব্রাহাম অ্যাকর্ড থেকে বেরিয়ে আসায় সৌদি আরব প্রশংসিত হয়েছে। একই সঙ্গে সৌদি আরবে আরব, ইসলামিক ও আফ্রিকান সম্মেলন প্রমাণ করেছে, মুসলিম বিশ্বের একতাবদ্ধ হওয়া এখন কতটা প্রয়োজন। বিশেষ করে যখন কূটনৈতিক নীতি সংকটে পড়ে।
যদিও সৌদি আরবের কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পুরো বদলে গেছে, এমনটা বলার সময় এখনো আসেনি। বিদেশনীতি পরিবর্তনকে ঘিরে দেশটির যে তৎপরতা, তাকে স্বাগত জানানো উচিত।
যায়েদ এ বেলবাগি একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার
নিবন্ধটি আরব নিউজ–এ প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ।