জুলাই মাসে ওয়াশিংটনে ন্যাটোর ৭৫তম জয়ন্তীর জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন ইউক্রেনের জন্য শূন্য ঘণ্টা বাজাবে। ন্যাটো জোট শীতল যুদ্ধপরবর্তী পরীক্ষায় (ইউক্রেন যুদ্ধ) শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দুঃখজনকভাবে এটা অস্বীকারের উপায় নেই যে ভ্লাদিমির পুতিনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন।
রাশিয়ান বাহিনী এখন খারকিভের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তার কারণ হলো, ইউক্রেনকে পশ্চিমা শক্তিগুলো খুব ধীরে ধীরে অস্ত্রের জোগান দিয়েছে। পশ্চিমা নেতারা ভেবেছেন ইউক্রেনকে অস্ত্র দেওয়াটা তাদের জন্য অপরাধ। অস্ত্র দিলে রাশিয়ার সঙ্গে উত্তেজনা বাড়বে কি না, সে ভয়ও তাদের রয়েছে। ফলে ইউক্রেন যে অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছে, তা দিয়ে তারা শুধু নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, জয়ী হতে পারেনি। আর এখন ইউক্রেন তাদের সেই অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
জো বাইডেন বলেছেন, ‘ইউক্রেনের স্বাধীনতার মানে হলো বৈশ্বিক স্বাধীনতা। এটা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই।’ ঋষি সুনাক বলেছেন, ‘ইউক্রেনের প্রতি আমাদের সমর্থন বৃথা যেতে পারে না। যত দিন প্রয়োজন, তত দিন পর্যন্ত ব্রিটেন ইউক্রেনের সঙ্গে থাকবে।’ কিন্তু বাস্তবে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একাই লড়ে যেতে হচ্ছে ইউক্রেনকে।
আমি বারবার আমার লেখায় বলে এসেছি, ইউক্রেন আগ্রাসনের একেবারে শুরু থেকে ন্যাটোর উচিত ছিল রাশিয়াকে প্রবলভাবে বাধা দেওয়া। ইউক্রেনের আকাশসীমাকে যদি ‘উড্ডয়ন নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা হতো, তাহলে হাজার হাজার মানুষকে হতাহত হওয়া থেকে বাঁচানো যেত, ইউক্রেনের শহরগুলোকেও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যেত।
পশ্চিমাদের অস্ত্র ব্যবহার করে রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি ও তেল শোধনাগারে হামলা করতে না দেওয়ার বিষয়টি ন্যাটোর জন্য আত্মপরাজয়ের শামিল। কৃষ্ণসাগরের বন্দর দিয়ে ইউক্রেনের শস্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ন্যাটো রক্ষণাত্মক অবস্থানে থেকে পাহারা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটাও শিশুতোষ সিদ্ধান্ত। পুতিনকে অবশ্যই ন্যাটো নেতাদের জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে তিনি যে প্রতারণা করছেন, তার মোক্ষম জবাব কী।
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট তার প্রতিবেশী ইউরোপের একটি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে তারা কম শক্তিশালী ও কর্তৃত্ববাদী একটি আগ্রাসী শক্তির অবৈধ আগ্রাসন, ধ্বংসযজ্ঞ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে বাঁচাতে পারেনি। এর থেকে অনন্য আর কী হতে পারে!
অবশ্য এ সবকিছু এখনো করা সম্ভব। তার জন্য ইচ্ছা থাকতে হবে। ন্যাটোর সাবেক শীর্ষ কমান্ডার জেনারেল রিচার্ড শিরেফ আহ্বান জানিয়েছেন, ইউক্রেন নিয়ে এমন কার্যকর কৌশল নিতে হবে, যেন যুদ্ধক্ষেত্রে ‘মৌলিক পরিবর্তন’ ঘটে। তাঁর এ অবস্থান সঠিক। রাজনীতিবিদেরা যে এ আহ্বান শুনতে শুরু করেছেন, তার কিছুটা লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন আর জার্মানিতে ওলাফ শলৎজ ইউক্রেনের জন্য অতিরিক্ত সহায়তা অনুমোদন দিয়েছেন। ফ্রান্সের এমানুয়েল মাখোঁ তাঁর আত্মতুষ্টির পথ থেকে সরে এসে এখন বলছেন, কেবল রাশিয়ার পরাজয়ই ইউক্রেনকে রক্ষা করতে পারে।
জুলাই মাসের সম্মেলনে ন্যাটোর জন্য প্রথম পদক্ষেপটি হতে পারত ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়া। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়ার বিরোধী অবস্থা নিয়েছে। অন্য দেশগুলোও সেই একই পথে হাঁটছে। সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি না দিয়েই ন্যাটোর নেতারা কিয়েভকে বলেছে, ‘সব শর্ত অনুকূলে না আসা পর্যন্ত’ তাদের অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু ইউক্রেনকে সদস্যপদ না দেওয়ার প্রকৃত কারণ ভিন্ন। রাশিয়া প্রতিশোধ নেবে কি না, সে ভয় করছেন বাইডেন। অথচ শীতল যুদ্ধের সময়কার সেই ভয় এখন বাস্তবে অমূলক। বাইডেন কি এখনো বিশ্বাস করেন, পুতিন ন্যাটোর ৩২টি দেশে একযোগে হামলা করবেন? বরং কাপুরুষ পুতিনের জন্য পিছু হটাটাই বাস্তব।
ন্যাটোর সাবেক মহাসচিব আন্ডার্স ফঘ রাসমুসেনের ধারণাটি এ ক্ষেত্রে সঠিক। তিনি চান, ন্যাটোয় ইউক্রেনের প্রবেশের ব্যাপারে কথাবার্তা এখনই শুরু করা হোক। জার্মানি যেন ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেয়। তিনি বলেন, ‘আপনি যদি এই যুক্তি দেন যে যুদ্ধ যত দিন চলবে, তত দিন ন্যাটোয় ইউক্রেনকে আমন্ত্রণ জানানো যাবে না, তাহলে আপনি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য পুতিনকে প্রণোদনা জুগিয়ে যাচ্ছেন।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও (ইইউ) উচিত দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসা। কেননা, যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি ক্রমাগত শোচনীয় হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিত্ররা মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের জন্য তোলা ৬০ বিলিয়ন সহযোগিতার বিল দীর্ঘদিন আটকে রেখেছিল। এর সুযোগ নিয়েছে পুতিনের সেনারা। ইউক্রেন সেনার ঘাটতিতেও পড়েছে।
ইউক্রেনে স্থলসেনা পাঠানোর মাখোঁর প্রস্তাব খুব ক্ষোভের সঙ্গে খারিজ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন ও বার্লিন। কিন্তু মাখোঁর এ প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা দরকার।
কল্পনা করুন তো, ভবিষ্যতের ঐতিহাসিকেরা এসব ঘটনাকে কীভাবে দেখবেন?পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোট তার প্রতিবেশী ইউরোপের একটি গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে তারা কম শক্তিশালী ও কর্তৃত্ববাদী একটি আগ্রাসী শক্তির অবৈধ আগ্রাসন, ধ্বংসযজ্ঞ ও যুদ্ধাপরাধ থেকে বাঁচাতে পারেনি। এর থেকে অনন্য আর কী হতে পারে!
সিমন টিসডল, যুক্তরাজ্যের দ্য অবজারভার পত্রিকার পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাষ্যকার
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত