পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কার তুলনায় বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ পাকিস্তান ও ভারতকে মাথাপিছু জিএনআইয়ের দিক থেকে ছাড়িয়ে যেতে সমর্থ হয়েছে, যদিও ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান এখনো বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে বেশ খানিকটা ভালো রয়ে গেছে।

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে পাকিস্তানের অবস্থান প্রতিবছর নিচে নেমে যাচ্ছে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ যেখানে এ ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির ধারায় ১২৯ নম্বর অবস্থানে উন্নীত হয়েছে, সেখানে পাকিস্তানের অবস্থান নেমে গেছে ১৬১ নম্বরে, ভারতের অবস্থান ১৩৪ নম্বরে।

১৯৪৭-৭১ পর্বে পূর্ব বাংলাকে অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শোষণ, বঞ্চনা, সীমাহীন বৈষম্য ও লুণ্ঠনের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল পাকিস্তানের শাসকেরা, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে ৭০ শতাংশ কম ছিল। ২০১৫ সালেই বাংলাদেশ পাকিস্তানকে মাথাপিছু জিডিপির হিসাবে পেছনে ফেলে এসেছে। ২০২৪ সালে মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের তুলনায় ৭০ শতাংশ এগিয়ে গেছে।

এই অবস্থার স্বীকৃতি মিলেছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অগ্রগতি দেখে আমাদের লজ্জা হয়। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বলা হতো, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বোঝা। এখন ওই বোঝা কোথায় পৌঁছেছে আর আমরা কোথায়।’

অন্যদিকে আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক-২০২০-এর প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ওই বছরের ডিসেম্বর নাগাদ মাথাপিছু নমিনাল জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশ ভারতকেও টপকে গেছে। ২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশিদের মাথাপিছু জিএনআই ২ হাজার ৭৮৪ ডলারে পৌঁছেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো তথ্য প্রকাশ করেছে।

এই দাবি সত্য হলে এখনো বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু জিএনআই ভারতীয়দের চেয়ে বেশি রয়ে গেছে। (অবশ্য গত অর্থবছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি ছিল)। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির (পিপিপি) বা ক্রয়ক্ষমতার সমতার ভিত্তিতে ২০২২ সালে ভারতের প্রাক্কলিত মাথাপিছু জিএনআই ছিল ৮ হাজার ২১০ পিপিপি ডলার আর বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮৯০ পিপিপি ডলার।

এর মানে, ভারতে বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম হওয়ায় ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে উঁচু।

সাধারণভাবে যেসব দেশের মাথাপিছু জিডিপি কম, সেসব দেশে অধিকাংশ পণ্য ও সেবার দামও তুলনামূলকভাবে কম হয়। এ ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের ব্যাপারটি অনেকখানি ব্যতিক্রম।

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে বেশি। খাদ্যদ্রব্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা—যেগুলোকে ‘মৌল প্রয়োজন’ বলা হয়, সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় সব পণ্য ও সেবার দাম বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে বেশি।

উদাহরণ: ১. চাল, আটা, ময়দা, মসলা, শাকসবজি, ডাল, মুরগি, ডিম, দুধ, মাখন—সবই ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে সস্তা।

২. শার্ট, ট্রাউজার, জিনস, টি-শার্ট, জুতা, স্যান্ডেল ছাড়া নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী ও শিশুর কাপড়চোপড় ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে সস্তা।

৩. ভারতে কম্পিউটারসহ অধিকাংশ ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম—মোবাইল-টেলিফোন কল অবশ্য বাংলাদেশে সস্তা।

৪. ভারতে বিদেশি গাড়ি খুব বেশি ব্র্যান্ডের পাওয়া না গেলেও ভারতে উৎপাদিত গাড়ির দাম বাংলাদেশে আমদানি করা গাড়ির তুলনায় অনেক কম।

৫. ভারতের বেশির ভাগ শহরে ও গ্রামে জমিজমার দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম।

৬. ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ রাজ্যগুলো ছাড়া অন্যত্র অধিকাংশ নির্মাণসামগ্রীর দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম। তাই অ্যাপার্টমেন্ট বা পাকা বাড়ির দাম ও নির্মাণের খরচও কম।

৭. ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে খরচ প্রাইমারি থেকে উচ্চতম লেভেল পর্যন্ত সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশের কাছাকাছি হলেও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার খরচ বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে বেশি।

৮. স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসার খরচ ভারতে বাংলাদেশের তুলনীয় পর্যায়ে হলেও এসব সেবার মান ভারতে উন্নততর।

৯. ভারতে বাস, ট্রেন, ট্যাক্সি ও প্লেনের ভাড়া বাংলাদেশের তুলনায় কম।

সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত বলছে, ভারতে মূল্যস্ফীতির হার ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ বাংলাদেশে এখনো সরকারি হিসাব মোতাবেক মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দিচ্ছে যে মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে আরও অনেক বেশি হবে। এ জন্যই বলছি, ভারতের জনগণের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো রয়েছে।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু জিএনআই নমিনাল ডলারে ছিল ৩ হাজার ৬১০ ডলার এবং পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি পদ্ধতিতে ছিল ১৪ হাজার ৩০ পিপিপি ডলার।

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৭৬ নম্বরে। এর মানে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক উন্নয়ন দক্ষিণ এশিয়ার বড় দেশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রগামী ছিল। যদিও ২০২১ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি মারাত্মক মন্দার শিকার হয়েছিল, তবু এর প্রভাবে দেশটির জনগণের জীবনযাত্রার মানে কতখানি বিপর্যয় ঘটেছে, তার সর্বশেষ হিসাব আমরা পাইনি। ২০২২ সালের মাথাপিছু জিএনআই ৪ হাজার ডলার থেকে কমে যাওয়ায় তার কিছুটা আলামত মিলেছে।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে যে ২০২৪ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি মন্দার বিপর্যয় অনেকখানি কাটিয়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতির হার ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও নাকি আবার সাধারণ জনগণের নাগালে চলে এসেছে। তাদের পর্যটনশিল্প আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে। প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের প্রবাহে যে ধস নেমেছিল, তা-ও প্রায় কাটিয়ে ওঠা গেছে। তবু সর্বশেষ হিসাবে, শ্রীলঙ্কার মাথাপিছু জিএনআই বর্তমানে আবার ৪ হাজার নমিনাল ডলারে ফিরে যেতে পেরেছে কি না, জানা যায়নি।

তবু বলতে হবে, অর্থনৈতিক সাময়িক বিপর্যয় সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কার জনগণের জীবনযাত্রার মান হয়তো ২০২৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাত্রার মানের চেয়ে ভালো রয়ে গেছে। শ্রীলঙ্কার শতভাগ জনগণ শিক্ষিত। ফলে শ্রীলঙ্কায় দক্ষ জনশক্তির অনুপাত ভারত ও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। ওখানকার স্বাস্থ্যব্যবস্থাও শতভাগ জনগণের সাধ্যের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা হয়। শ্রীলঙ্কার সড়ক ও রেল যোগাযোগব্যবস্থা অনেক উন্নত, পরিবহনব্যবস্থাও বাংলাদেশের তুলনায় ব্যয়সাশ্রয়ী। ওখানে শহর ও গ্রামের জনগণের জীবনযাত্রার মানের ব্যবধান খুব বেশি নয়।

দেশটির রাজধানী কলম্বোর জনসংখ্যা ৫৬ লাখের মতো, অথচ ১৯৭২ সালে কলম্বো ঢাকার চেয়ে জনসংখ্যার দিক থেকে বড় নগর ছিল। কিন্তু অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে শ্রীলঙ্কার শাসকেরা কলম্বোর জনসংখ্যাকে দ্রুত বাড়তে দেননি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ায় শহর ও গ্রামের জনগণের জীবনযাত্রার মানের পার্থক্য তেমন বাড়তে পারেনি। ১৯৮২ সাল থেকে তিন দশক ধরে মারাত্মক গৃহযুদ্ধের কবলে না পড়লে শ্রীলঙ্কা সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকংয়ের পর পঞ্চম ‘এশিয়ান টাইগার’ হয়ে উঠত বলে ধারণা করা হয়। ২০২৪ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা আবার উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ হয়ে উঠবে বলে আমার ধারণা।

অতএব, এখন বাংলাদেশের লক্ষ্য হওয়া উচিত মাথাপিছু জিএনআইয়ের দিক থেকে আগামী কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কাকে ছুঁয়ে ফেলা। দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে পারলে বাংলাদেশের জন্য এই টার্গেট অর্জন দুঃসাধ্য হবে না।

● ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক