ঢাকার রাস্তায় চারটা জলজ্যান্ত প্রাণ নাই হয়ে গিয়েছে তিন দিনও পার হয়নি। এর মধ্যেই দেশের গণমাধ্যমগুলোয় হাসিমাখা ছবি দেখা যাচ্ছে আমাদের মন্ত্রী-এমপিদের। মন্ত্রী, এমপি আর মেয়রদের কথায় সিঙ্গাপুর হয়ে যাওয়া ঢাকা শহর ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছে। সেই পানিতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়েছে। সেই বিদ্যুৎ কেড়ে নিয়েছে চার চারটা তাজা প্রাণ।
অবশ্য সাধারণ মানুষ বেঘোরে মারা গেলে আমাদের কর্তা-ব্যক্তিদের বোধকরি কিছু যায় আসে না। তাঁদের সব ধ্যান-জ্ঞান, সাধনা আটকে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কখন কী বলছে, এসব নিয়ে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে, মন্ত্রী-এমপি বিরোধীদলীয় নেতা—সবাই ব্যস্ত আছে ইউরোপ-আমেরিকা কখন কী বলছে, এই বিশ্লেষণে। দেশের ঢাকার রাস্তায় মানুষ মারা গেলে যেমন তাঁদের কিছু যায় আসে না, তেমনি চট্টগ্রামের রাস্তায় বৃষ্টির সময় ম্যানহোলে পড়ে মা তাঁর সন্তানকে হারালেও কারও কিছু যায় আসে না।
তবে এই রাজনীতিবিদেরা কথায় কথায় বলে থাকেন, জনগণই ক্ষমতার উৎস! আপনারা যদি বিশ্বাস করেই থাকেন, জনগণ ক্ষমতার উৎস। তাহলে সর্বক্ষণ আপনাদের ইউরোপ-আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় কেন?
আপনাদের এক মন্ত্রী ভারত থেকে ফিরে এসে ঘোষণা করেন—‘বলে এসেছি আমাদের ক্ষমতায় রাখতে।’ কেউ আবার সম্মেলনে গিয়ে সেলফি তুলে বোঝাতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কত ভালো। এদিকে নিজ দেশের রাজধানী শহরে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে ছিল দীর্ঘ সময়। কাউকে এ নিয়ে কিছু বলতেও শোনা যাচ্ছে না, কিছু করতেও দেখা যাচ্ছে না।
ভাবখানা এমন, এতে সমস্যা কোথায়? মানুষ আটকে থাকবে রাস্তায়। হয়রানির শিকার হবে। বেঘোরে মারা যাবে। এসব তো স্বাভাবিক বিষয়। এসব নিয়ে এত কথা বলার কী আছে। কথা তো বলতে হবে—যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে!
এ দেশের জনগণের প্রতি আদৌ কি আপনাদের কোনো দায়বদ্ধতা আছে? এই যে এত নির্লজ্জের মতো আপনারা ভারত-আমেরিকা-ইউরোপ এসব নিয়ে কথা বলছেন, এতে কি সাধারণ মানুষের বুঝতে বাকি আছে, আপনারা আসলে কীভাবে ক্ষমতায় যান কিংবা টিকে থাকেন? সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ায় আপনাদের কিছু যায় আসে না। তাই সাধারণ মানুষ রাস্তায় মরে পড়ে থাকলেও আপনাদের বুক কেঁপে ওঠে না। বস্তির মানুষ আবার মানুষ নাকি!
প্রতিবছর ডেঙ্গুতে মানুষ মারা যাচ্ছে আর আপনাদের মেয়র এসে বলেছেন, মানুষ নাকি তাঁর কথা শোনে না। বাসাবাড়ি ময়লা করে রাখে! অর্থাৎ যত দোষ ওই সাধারণ মানুষের। সামান্য বৃষ্টিতে পানি উঠে গেলে মেয়র মশাই এসে বলেন, মানুষ পলিথিন রাস্তায় ফেলে রাখে, পানি তো উঠবেই। তা মেয়র মশাই, আপনি আছেন কী করতে? জগতে এমন কোনো দেশ আছে, যে দেশের মানুষ আইন ভঙ্গ করতে চায় না?
ইউরোপে যুগের পর যুগ থেকে একটা বিষয় অন্তত আমি পরিষ্কার হয়েছি, সবাই আইন ভাঙতে চায়। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় কেউ আইন ভাঙে না। কারণ, ভাঙলে যে জরিমানা হয়। সেই জরিমানার পরিমাণ এত বেশি, ভয়েই লোকজন আইন ভাঙে না। এমনকি নিজের বাড়ি, বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার না রাখলেও জরিমানা হয়ে যায়।
আর আমাদের মেয়র এসে বলছেন, মানুষ কথা শোনে না। তাহলে আপনি আছেন কেন? মেয়রের কাজটা কী? অবশ্য আপনাদের লোকজনদের কাজই তো হচ্ছে নিজেরাই আইন ভেঙে, ঘুষ খেয়ে এরপর আইনের সাফাই গাওয়া! এর চেয়ে ওই চেয়ারটায় একটা কলাগাছ বসিয়ে রাখলে এর চেয়ে খারাপ কিছু হবে বলে তো মনে হচ্ছে না!
যে চারজন মানুষ ঢাকার রাস্তায় মারা গিয়েছে, তাঁরা অবশ্য ঢাকায় এসেছিলেন বেঁচে থাকার তাগিদে। স্রেফ বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছিলেন তাঁরা। বেঁচে থাকতে পারলেই হয়তো তাঁরা একসময় বলতেন, ভালো আছি। কিন্তু আপনাদের মতো কর্তা-ব্যক্তিদের জন্য এই মানুষগুলো বেঁচেও থাকতে পারলেন না। কারণ, শহরটাকে আপনারা নরক বানিয়ে ছেড়েছেন। আপনারা মন্ত্রী, এমপি, মেয়র হন। এরপর আপনাদের দায়িত্বটা আসলে কী?
এই যে চারটা মানুষ মুহূর্তে নাই হয়ে গেল, এর দায় তাহলে কার? কাউকে কি দেখা গিয়েছে এই জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে? কিংবা দায় স্বীকার করতে? দেখা যায়নি। কারণ, তাঁরা ব্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়েই তো ব্যস্ত থাকতে হবে। তাঁদের সন্তানেরা থাকে যুক্তরাষ্ট্রে। পড়াশোনা করে আমেরিকা-ইউরোপে। তাঁরা বাড়ি বানান যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে তাঁদেরই তো মাথা ঘামানোর কথা।
যে চারজন মানুষ ঢাকার রাস্তায় মারা গিয়েছে, তাঁরা অবশ্য ঢাকায় এসেছিলেন বেঁচে থাকার তাগিদে। স্রেফ বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছিলেন তাঁরা। বেঁচে থাকতে পারলেই হয়তো তাঁরা একসময় বলতেন, ভালো আছি। কিন্তু আপনাদের মতো কর্তা-ব্যক্তিদের জন্য এই মানুষগুলো বেঁচেও থাকতে পারলেন না। কারণ, শহরটাকে আপনারা নরক বানিয়ে ছেড়েছেন। আপনারা মন্ত্রী, এমপি, মেয়র হন। এরপর আপনাদের দায়িত্বটা আসলে কী?
দেশের মানুষগুলো স্বাভাবিক জীবন চায়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাও চায় না। বেগমপাড়ায় প্রাসাদসম বাড়িও চায় না। এই সামান্য চাওয়াটুকুও আপনারা পূরণ করতে পারেন না!
ড. আমিনুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, এস্তোনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি
ই-মেইল: [email protected]