ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন যুদ্ধ আবারও এমন এক মোড় নিয়েছে, যা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন ও তাঁর গুরুত্ববাহী ২৪ ঘণ্টার বিদ্রোহকে নিন্দা জানিয়ে পুতিন যে ভাষণ দিয়েছেন, তা থেকে পরিষ্কার হয়েছে, পুতিন বুঝতে পারছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি তাঁর জন্য কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। যদি এই অবস্থা মোকাবিলা করার মতো তাঁর হাতে সত্যিই কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা থাকত, তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে এ বিষয়ে কাউকে কিছুই বলতেন না। সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।
প্রিগোশিনের এই বিদ্রোহকে পুতিন অতীতের সেই ‘চক্রান্তের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে দুর্বল করেছিল এবং একপর্যায়ে তা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই ভেঙে ফেলেছিল। প্রিগোশিনের অনুগত বাহিনী ও রাশিয়ার নিয়মিত সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর সপ্তাহ দুয়েক চুপ থেকেছিলেন পুতিন। তবে পরিস্থিতি গুরুতর দিকে মোড় নেওয়ায় তিনি প্রিগোশিনের এই বিশ্বাসঘাতকতাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভাষণ দিতে বাধ্য হন।
মস্কোর প্রতি প্রিগোশিনের ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জকে এক দল খুনি ও অপরাধীর সরদার এবং ক্রেমলিনের গদিতে বসে থাকা একজন মাফিয়া বসের যুদ্ধ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে শেষ কথা হলো, এর মধ্য দিয়ে যে বিভ্রান্ত ও দুর্বল রাশিয়ার চেহারা প্রকাশ পেয়েছে, তা সবার জন্যই সুখের খবর
পুতিনের ভাষণে ১৯১৭ সালের সেনা বিদ্রোহের ঘটনা টানার যে মানে দাঁড়ায়, তা হলো, পুতিন এই বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার বিষয়ে অনেক দেরি করে ফেলেছেন এবং এই বিদ্রোহ রাশিয়ায় এখন পুতিনের ক্ষমতা ধরে রাখার বিষয়ে সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
পুতিনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো ক্ষমতা প্রিগোশিন বা তাঁর বাহিনীর ছিল না। তাঁরা চাইলেও সরাসরি পুতিনের মুঠোবন্দী ক্ষমতাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন পরোক্ষভাবে হলেও তাঁরা পুতিনের ক্ষমতা ধরে রাখা মুষ্টির দুর্বলতাকে ফাঁস করে দিয়েছেন। এখন এক দল সশস্ত্র যোদ্ধা দক্ষিণ রাশিয়ার এলাকাগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন।
পুতিন তাঁর ক্ষমতাকে সংহত করতে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন, সেই চেষ্টার সাফল্য থেকে তিনি যে অনেক দূর পিছিয়ে আছেন, বর্তমান বাস্তবতা সেটিই প্রমাণ করছে।
রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি, স্থাপনাসহ রুশ গোয়েন্দা-বিশেষ বাহিনীর সঙ্গে ভাগনার গ্রুপের দীর্ঘদিনের জানাশোনা। রাশিয়ার বহু সামরিক ঘাঁটি গ্রুপটি ব্যবহার করে আসছিল। ফলে নিয়মিত বাহিনীর কোন গ্রুপের কতজন ভাগনার গ্রুপের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন বা ভাগনার গ্রুপের মস্কো অভিযান ঠেকাতে কোন বাহিনী কীভাবে দাঁড়াবে, তা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে ওঠা কঠিন।
ধারণা করা যায়, রাশিয়ার যেকোনো সামরিক, আধা সামরিক বা গোয়েন্দা সংস্থার ইউনিট বা গোষ্ঠী প্রিগোশিনের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করতে পারে অথবা ভাগনারদের বাধা দিতে অস্বীকার করে শক্তির ভারসাম্যে দ্রুত পরিবর্তন আনতে পারে।
যদিও কিয়েভের জন্য এটি একটি ভালো খবর যে রাশিয়ার কিছু বাহিনী সাময়িকভাবে হলেও বিভ্রান্ত হয়েছে; তবে এতে এটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে এই পরিস্থিতি ইউক্রেন ও ইউরোপের হুমকিকে কমিয়ে দেবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ করা ঠিক হচ্ছে নাকি ভুল, সেটি নিয়ে প্রিগোশিনের মাথাব্যথা নেই। যুদ্ধটা কীভাবে হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে—সেটিই তাঁর তর্কের মূল বিষয়। প্রিগোশিন ও পুতিনের এই দ্বন্দ্ব হলো এমন দুই দল নিকৃষ্ট মানুষের লড়াই, যাঁদের সবাই ইউক্রেনকে ধ্বংস করতে চান। ইউক্রেনকে কে কতটা দক্ষতার সঙ্গে ধ্বংস করবে, তাই নিয়েই তাঁদের দ্বন্দ্ব।
রাশিয়ার বাহিনীতে একটি বিশৃঙ্খলা হবে এবং সেটিকে কাজে লাগাতে হবে—এমন একটি সুযোগ খুঁজে আসছে ইউক্রেন। সেই সুযোগটি এখন তাদের সামনে এসেছে। এখন এমনকি প্রিগোশিনের বিদ্রোহ যদি থেমেও যায়, তাহলেও এই বিদ্রোহ রাশিয়ার সেনাবাহিনী ও কমান্ডারদের মধ্যে ব্যাপকভাবে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা ও অবিশ্বাসের বীজ রুয়ে দেবে।
ইউক্রেনীয় প্রচারযন্ত্রগুলো সেই বিভ্রান্তিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আরও বড় করে তুলবে বলে ধরে নেওয়া যায়। এ কারণেই প্রিগোশিনের ঘোষণা যাতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য রাশিয়া ইন্টারনেট যোগাযোগে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
মস্কোর প্রতি প্রিগোশিনের ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জকে এক দল খুনি ও অপরাধীর সরদার এবং ক্রেমলিনের গদিতে বসে থাকা একজন মাফিয়া বসের যুদ্ধ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তবে শেষ কথা হলো, এর মধ্য দিয়ে যে বিভ্রান্ত ও দুর্বল রাশিয়ার চেহারা প্রকাশ পেয়েছে, তা সবার জন্যই সুখের খবর।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
কির জাইলস চ্যাটাম হাউসের রাশিয়া অ্যান্ড ইউরেশিয়া প্রোগ্রামে কর্মরত আছেন। তিনি রাশিয়া’স ওয়ার অন এভরিবডি বইয়ের লেখক