রসের বইমেলা: ‘আজকের সংগ্রহ’ ও ‘লাগে তো কিছু বই!’

বইমেলায় গোটাকয় চক্কর দিলে অনেক ছেঁড়া ছেঁড়া ঘটনা ও দৃশ্য চোখে পড়তে পারে। বাস্তব ঘটনার ছায়া অবলম্বন করে তিনটি কল্পদৃশ্য দেখাচ্ছি। চলুন দেখি:

 ১.

বইমেলার একটা বড় স্টল। ২৫-২৬ বছরের এক যুবক এসেছেন। তাঁর চেহারায় বোদ্ধা পাঠকের ছাপ। বিক্রয়কর্মী তাঁর তর্জনী-নির্দেশে একটা একটা করে বই তাক থেকে নামিয়ে একটার ওপর একটা রাখছেন। এর মধ্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হুমায়ূন আহমেদ, আনিসুল হক, জাফর ইকবাল থেকে শুরু করে কাশেম বিন আবু বাকার হয়ে হিরো আলমেরও বই আছে।

বিদগ্ধ যুবক সবগুলো বইকে সুন্দর করে স্তূপ করতে বললেন। বিক্রয়কর্মী তাই করলেন। যুবক এবার মোবাইল ফোনে বইগুলোর ছবি তুললেন। এরপর স্তূপটার পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুললেন। ফেসবুকে ছবিগুলো আপলোড করলেন। ক্যাপশনে লিখলেন, ‘আজকের সংগ্রহ’। তারপর তিনি একটা বইও না কিনে স্টল থেকে বেরিয়ে গেলেন।

২.

একটা নামকরা প্রকাশনীর স্টলে একজন নামকরা সেলিব্রিটি দাঁড়িয়েছেন। এ বছর মেলায় তাঁর লেখা একটি কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছে। সেলিব্রিটির সামনে ১৪-১৫ জন তরুণ-তরুণী লাইন ধরে আছেন। তাঁরা একজন একজন করে আসছেন; একটা করে কবিতার বইটি কিনছেন। সঙ্গে ফাউ পাচ্ছেন একটি করে অটোগ্রাফ ও সেলফি তোলার সুযোগ। ঘণ্টাখানেক পর সেলিব্রিটি ‘আর থাকতে পারছি না!’ বলে বেরিয়ে গেলেন। সারিবদ্ধ ক্রেতারাও চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল।

স্টলে বসা এক বিক্রয়কর্মী আরেক বিক্রয়কর্মীকে বললেন, ‘আগে লোকে বই লিখে সেলিব্রিটি হতো, এখন সেলিব্রিটি হওয়ার পর বই লেখে। এই লোকের বই ছাপাইছিলাম এক হাজার কপি। সব পইড়া আছে। এমনিতে কেউ কেনে না। এই কারণে আইজ জোর কইর‍্যা এক ঘণ্টার জন্যি স্টলে আনছি। তাতে কিছু কপি বেচা হইছে।’

বইমেলায় বড় পুঁজি যুক্ত হওয়ায় এবং ধীরে ধীরে মেলা করপোরেট চেহারা পাওয়ায় এটি একটি ‘বিনোদন পার্কের’ আদল পেয়েছে। ফলে প্রচুর লোক আসছে। স্বাভাবিক বই কেনার পাশাপাশি লোকদেখানো বই কেনাও হচ্ছে। বইমেলাকে বইমেলায় আটকে না রাখার কৃতিত্ব এই ‘লোকদেখানো’ ক্রেতাদেরও কম না।

৩.

এক ভদ্রমহিলা ঘুরে ঘুরে অনেকগুলো বই কিনেছেন। উপন্যাস, গল্প, কবিতা, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, বাচ্চাদের রূপকথা, ভূতের বই, ছড়ার বই—নানান পদের বইভর্তি চার–পাঁচটা ব্যাগ তাঁর হাতে। তাঁর এক পরিচিত নারী বললেন, ‘ভাবি, এত বই কিনলেন যে!’ ভদ্রমহিলা মিষ্টি করে হেসে বললেন, ‘লাগে তো কিছু বই! আপনার ভাই শখ করে একটা আলমিরা কিনেছে, একদম খালি খালি লাগছে!’

এই দৃশ্যগুলো ফেলনা না। পুরোপুরি মিথ্যাও না। সত্যিকার পাঠকের সত্যি সত্যি বই কেনার দৃশ্যের ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে থাকা এই ‘মিথ্যামিথ্যি’ বই কেনার ঘটনাগুলো আছে। থাকাটা জরুরিও। কারণ কৃষি মেলা, বাণিজ্য মেলা, শাড়ি মেলা, গাড়ি মেলা, জামাই মেলা, বউ মেলার মতো বইমেলাও একটা মেলা।

মেলা মানে রং–তামাশার ব্যাপার। এক অর্থে বইমেলা তার বাইরের কিছু না। মেলার আগে মেলা নিয়ে প্রকাশকের টেনশন থাকে; লেখকের আকুলিবিকুলি থাকে। পাঠকের থাকে আগ্রহ; অপাঠকের থাকে আদিখ্যেতা। টেনশন, আগ্রহ, আকুলিবিকুলি, আদিখ্যেতা—সব মিলিয়ে-ঝিলিয়ে একটা সরগরম অবস্থা তৈরি হলে বইয়ের ‘বিক্কিরি’ ভালো হয়। তখন বইমেলা আসল ‘মেলা’ হয়ে ওঠে।

বহু লোক যেমন বই কেনার জন্যই বইমেলায় যায়; তেমনি ছুটির দিনে ঘরে আটকা থেকে মেলার মাঠে বাতাসা খেতে খেতে তামাশা দেখে সময় পার করতে আসা লোকের সংখ্যা কম থাকে না। মেলাকে সরগরম রাখতে তাদের অবদানই বড়।

কাপড়ের দোকানদার সারা বছর জামাকাপড় বেচলেও একটা ধুন্ধুমার বেচাবিক্রির জন্য ঈদ ও পূজার উৎসবের জন্য যেভাবে উন্মুখ হয়ে থাকে, তেমনি প্রকাশক ওরফে বই ব্যবসায়ীরাও ফেব্রুয়ারির বই মেলার দিকে চেয়ে থাকে। লেখকেরাও।

বাঙালি উৎসববাজ বলেই উপলক্ষ পাওয়ামাত্র তার উৎসবে মাততে অসুবিধা হয় না। উৎসবের সঙ্গে যোগ হয় হুজুগ। হুজুগটা লাগসই হলে যুগোৎসব জমে ওঠে।

মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা ছালা বিছিয়ে বই বেচতে বসার সময় কি ভেবেছিলেন, সেই ‘আল-ছালাদিয়া’ বইমেলায় কোটি কোটি টাকার বই কেনাবেচা হবে?

বইমেলায় বড় পুঁজি যুক্ত হওয়ায় এবং ধীরে ধীরে মেলা করপোরেট চেহারা পাওয়ায় এটি একটি ‘বিনোদন পার্কের’ আদল পেয়েছে। ফলে প্রচুর লোক আসছে। স্বাভাবিক বই কেনার পাশাপাশি লোকদেখানো বই কেনাও হচ্ছে। বইমেলাকে বইমেলায় আটকে না রাখার কৃতিত্ব এই ‘লোকদেখানো’ ক্রেতাদেরও কম না।

আরেকটা কথা। বই ‘কেনা’ মানেই কি ‘পড়া’? স্টিফেন হকিংয়ের বই আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম পৃথিবীজুড়ে ‘নাম্বার ওয়ান বেস্টসেলার’। প্রায় ৪০টি ভাষায় অনূদিত এই বই বিক্রি হয়েছে এক কোটির বেশি কপি। আবার এই বইকেই বলা হয় ‘সর্বকালের সবচেয়ে না-পড়া বই’।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    [email protected]