আওয়ামী লীগের কাউন্সিল শেষ হলো। এই কাউন্সিলগুলো যে আদতে কাউন্সিল নয়, সেটা রাজনীতির ন্যূনতম খোঁজখবর করা মানুষ জানেন, এটা আসলে দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্ত ঘোষণার অনুষ্ঠান। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে একদিনে নামিয়ে আনা হলেও কাউন্সিলে বেশ জাঁকজমকের মাধ্যমেই আগামী তিন বছরের জন্য আওয়ামী লীগের কমিটি নির্ধারিত (নির্বাচিত নয়) হলো। এই সম্মেলনটি এমন সময় হলো যখন দলটি দাঁড়িয়ে আছে তার ৭৫ বছর পূর্তির খুব কাছে। এমন পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দলটি দাঁড়িয়ে আছে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি— আওয়ামী লীগ কি আর রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালন করছে?
২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আমরা যদি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিক্রমা খেয়াল করি, তাহলে দেখব, তারা প্রতিপক্ষকে নানাভাবে নাস্তানাবুদ করে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে।
২০১৪ সালে একটি ভোট পড়ার আগেই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার মতো আসন নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের। এই তথাকথিত নির্বাচনটি সংবিধানের ৭(১), ১১, ৬৫(২) অনুচ্ছেদগুলোর এবং সর্বোপরি সংবিধানের স্পিরিটের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। বিষয়টি ক্ষমতাসীনেরাও বুঝেছিল নিশ্চয়ই। তাই ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল এটি একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় নিয়ম রক্ষার নির্বাচন, সবার অংশগ্রহণে অচিরেই আরেকটি নির্বাচন দেওয়া হবে। কিন্তু না, আওয়ামী লীগ ক্ষমতার পূর্ণ মেয়াদ পার করল।
এরপর ২০১৮ সালে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ অনেকগুলো বিরোধী দল নির্বাচনে আসে। কিন্তু আলোচিত ‘রাতের ভোট’ করে ক্ষমতায় থেকে যায় আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায় ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ৫৮৬টি কেন্দ্রে দেওয়া ভোটের শতভাগ পেয়েছে নৌকা প্রতীক ও একটিতে পেয়েছে ধানের শীষ প্রতীক। ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে বিএনপি শূন্য ভোট পেয়েছে।
৯৬ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে ১ হাজার ৪১৮টি ভোটকেন্দ্রে। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬ হাজার ৪৮৪টি কেন্দ্রে। সেই নির্বাচন কেমন হয়েছে, এই তথ্যগুলোই সেটা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। এরপরও দলটি ক্ষমতায় থেকে গেল এবং তার চার বছর পূর্ণ করে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে এবারও মেয়াদ পূর্ণ করবে আওয়ামী লীগ।
মানুষের ম্যান্ডেট ছাড়া এক দশকের মতো ক্ষমতায় থাকার ফলে ন্যূনতম জবাবদিহির ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে এই রাষ্ট্র এবং এর নাগরিকদের ভবিষ্যৎকে একেবারে গভীর খাদে নিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের দুর্নীতির ধরন, ব্যাপ্তি ও মাত্রা আলোচিত হতে থাকবে বহুকাল। কিন্তু দুর্নীতির চেয়েও অনেক বড় বিষয় হচ্ছে গত এক দশক জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোটিকে প্রায় ভেঙে ফেলেছে সরকার।
বাংলাদেশে ক্ষমতার পৃথক্করণ কোনোকালেই খুব একটা ভালো ছিল না। ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে বাংলাদেশের ন্যূনতম কার্যকর আইন বিভাগ সাংবিধানিকভাবেই নেই। নির্বাহী বিভাগের পূর্ণ কর্তৃত্বে চলেছে আইন বিভাগ। অপর বিভাগটির (বিচার) ওপরও নানাভাবে খবরদারি ফলিয়েছে নির্বাহী বিভাগ।
কিন্তু বর্তমান সরকারের সময় নির্বাহী বিভাগ বাকি দুটি অঙ্গকে যেভাবে নিজের কবজায় নিয়ে ফেলেছে, সেটা অভূতপূর্ব। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম স্বকীয় অস্তিত্ব এখন আর নেই। ১০ বছর ভোট ছাড়া ক্ষমতায় থাকার সময় রাষ্ট্রের ওপর পড়া প্রধান প্রভাব এটি।
বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিকে সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করে এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে আওয়ামী লীগ। এমন ‘সাফল্যের’ পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ক্রমাগত বিরোধীদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়। এমনকি অনেক ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ আওয়ামী লীগের এভাবে ক্ষমতায় থেকে যাওয়াকে একধরনের যোগ্যতা হিসেবেই দেখেন।
এভাবে পরপর দুটি মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পর সামনে যখন আরেকটি নির্বাচন এগিয়ে আসছে, তখন দলটি কী করবে, সেটা মানুষ নিশ্চিতই ছিল। গত কয়েক মাসে ক্ষমতাসীনদের আচরণ সেটাকে মানুষের সামনে প্রমাণ করেছে।
চার মাস আগে থেকেই বিএনপি যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে জনসভা করতে শুরু করে, তখন থেকেই ক্ষমতাসীন দল তাতে প্রচণ্ড বাধা তৈরি করে। কখনো কখনো পুলিশ আবার কখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা সেই জনসভাগুলোতে চরম বাধা তৈরি করেন, হামলা করেন। অসংখ্য বিএনপির নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে সাতজন বিএনপির নেতা-কর্মী।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীনেরা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আছে। সেই চাপের মুখে থেকে পরবর্তী সময় বিভাগীয় জনসমাবেশগুলোতে আর আগের মতো হামলা করে চরম বাধা তৈরি করতে চেষ্টা করেনি।
এরপর যখন বিএনপি বিভাগীয় জনসমাবেশগুলোর ঘোষণা দেয় তখন কিছু আপাত উদ্ভট কৌশল নেয় সরকার। বিএনপির জনসভায় জনসমাগম কমানোর জন্য প্রতিটি জনসভার দুই দিন আগে থেকে পরিবহন এবং ক্ষেত্রবিশেষে নৌ ধর্মঘট ডাকা হয়। জনসভার সময় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় যেন সে জনসভাগুলোর প্রচার ঠিকমতো না হয়। কিন্তু কোনোটিতেই উপচে পড়া ভিড় ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে এই কথাটাও আমরা মনে রাখব প্রতিটি জনসভা হয়েছে খুব শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে।
কিন্তু সবকিছুর পরও ঢাকা সমাবেশকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনেরা যা করল, সেটা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকেছে। কিন্তু আমার মনে হয় এটা ছাড়া আওয়ামী লীগের আর উপায়ই–বা কী ছিল? বল প্রয়োগের মাধ্যমে ভীতির সংস্কৃতি চালু এবং তা বজায় রাখার মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় টিকে আছে, সে দল ক্ষমতা ধরে রাখতে একই পথেই হাঁটবে, এটাই স্বাভাবিক। যা–ই হোক, জনগণের সামনে এটা খুব স্পষ্ট হয়ে গেছে যেনতেনভাবে আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতায় থাকাকে দীর্ঘায়িত করতে চায়। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ যা করছে, সেটা কতটা রাজনৈতিক?
একটা রাজনৈতিক দল চায় রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে তার চিন্তা ও দর্শন বাস্তবায়িত হোক। সেটা করতে গেলে একটা রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে চাপ তৈরির মাধ্যমেও অনেক কিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু এই বাস্তবায়নের কাজটা সবচেয়ে ভালো হতে পারে যখন রাজনৈতিক দলটি রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যায়। তাই এটা বলাই যায়, রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য রাষ্ট্রের ক্ষমতায় যাওয়া এবং সেটাকে যতটা সম্ভব প্রলম্বিত করা। কিন্তু আমাদের দেশেই ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ বলে যে শব্দযুগল ব্যবহৃত হয়, সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থে। প্রশ্ন তাহলে আসে ‘ক্ষমতার রাজনীতি’ কি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতির বাইরের কিছু?
রাজনীতির পথ পরিক্রমায় একটা রাজনৈতিক দল চিরকাল একই রকম আদর্শ এবং কর্মপন্থা ধরে রাখবে, এমনটা না–ও হতে পারে। তার আগের আদর্শ, বিশ্বাস কর্মসূচি কিংবা সেসব অর্জনের কর্মপন্থা সম্পর্কে ভিন্নভাবে ভাবতে পারে। অনেক সময় কোনো রাজনৈতিক দলের আদর্শ, বিশ্বাস ও সেটা অর্জনের পন্থা এতটাই পাল্টে যায় যে সেগুলোকে তার আগের অবস্থানের সঙ্গে কোনোভাবেই মেলানো যায় না।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সময় পুরো চীনের ক্ষমতায় ছিল কুওমিংটাং (কেএমটি) দলটি। পরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সেই দলের প্রধান নেতা চিয়াং কাইশেক দলের প্রায় সবাইকে নিয়ে একটা বড় জনগোষ্ঠীসহ পালিয়ে যান তাইওয়ানে। সেখান থেকেই তাঁরা পুরো চীনের বৈধ শাসকের দাবি করে যান এবং সেটা নিয়ে মাও সে–তুংয়ের নেতৃত্বাধীন চীনের মূল ভূখণ্ডের শাসকদের সঙ্গে সংঘাত তৈরি হয় তাঁদের। অথচ আজ অবিশ্বাস্যভাবে তাইওয়ানের প্রধান দুই দলের মধ্যে (অপরটি বর্তমান ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি, ডিপিপি) কেএমটি চীনের অনেক কাছাকাছি। একসময় পুরো চীনের কর্তৃত্ব দাবি করা কেএমটি এখন এমনকি তাইওয়ানের স্বাধীনতাও চায় না। তাই একসময়ের চরম শত্রু পার্টি কেএমটিকে তাইওয়ানের ক্ষমতায় আনার এবং রাখার জন্য চীন নানাভাবে চেষ্টা করে, এমন তথ্য লুকোছাপা নেই একেবারেই। চোখেপড়ার মতো এত বড় রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবর্তনের উদাহরণ আমাদের আশপাশের দেশে তো বটেই, আছে আমাদের দেশেও।
কোনো রাজনৈতিক দল একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় থেকে, সেখানে আস্থা রেখে তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা পরিবর্তন করতেই পারে। সেসব নিয়ে সমালোচনা হতে পারে, সেটা নিয়ে ‘রাজনীতি’ করতেই পারে অপর কোনো দল। কিন্তু দিনের শেষে একটা নির্বাচনের মাধ্যমেই ক্ষমতায় যাবে কিংবা থাকবে কেউ। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ এখন ব্যবসায়ী, আমলাসহ গঠিত একটা গোষ্ঠীর অংশে যেটির একমাত্র উদ্দেশ্য জনগণের ভোটাধিকারকে (যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা) নানা পন্থায় ধ্বংস করে যেকোনো মূল্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যাওয়া, এটা কোনো বিবেচনায়ই রাজনীতি হতে পারে না। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হলে কম্বোডিয়ার কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টিও রাজনৈতিক দল। দলটি হুন সেনের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আছে ২৫ বছর। গত নির্বাচনের আগে প্রধান বিরোধী দলকে (কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি) নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তারা জিতেছে ১২৫টি সংসদীয় আসনের সব কটিতেই।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের একবার অবলুপ্তি ঘটেছিল সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল তৈরি করার পর। এরপর সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত হয় দলটি। এরপর কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও এরশাদের সময় এবং তারপরও গণতান্ত্রিক পথেই চলেছিল দলটি। কিন্তু সবশেষ, বিশেষ করে ২০১৪ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ আর ‘রাজনীতি’ করছে বলে মনে না। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার নীতি গ্রহণ করা আওয়ামী লীগ আসলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করছে কি?
জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষক