একটি ভেঙে পড়া সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার ঘটনা অবধারিতভাবেই তাড়াহুড়া করে চালানো কোনো উচ্ছেদ অভিযানের কথা মনে করিয়ে দেয়। আতঙ্কিত মানুষেরা হতশ্রী দশার বিমানবন্দর টার্মিনালের দিকে পড়িমড়ি করে ছুটছেন। তাঁদের আশা, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি থেকে নিজেদের বাঁচাতে কোনো রকমে জরুরি ফ্লাইটে চড়ে বসতে পারবেন।
এটি নাইজারের রাজধানী নিয়ামির এই সপ্তাহের ছবি। ফ্রান্সের শত শত নাগরিক ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্য দেশগুলোর নাগরিকদের সঙ্গে এভাবেই তড়িঘড়ি করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটি ছেড়েছেন।
নাইজারের জাতীয় দিবসের মাত্র কয়েক দিন আগে দেশটির সেনাবাহিনীর একটা অংশ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বাজোমের সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেছে। ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছ থেকে নামমাত্র স্বাধীনতা লাভের পর নাইজার এ বছর ৬৩ বছর পূর্তি উদ্যাপন করেছে।
গত সপ্তাহে বিক্ষুব্ধ জনতা ‘ফ্রান্স নিপাত যাক’ স্লোগান দিতে দিতে ফ্রান্স দূতাবাস আক্রমণ করেন। তাঁরা ঢিল ছুড়ে দূতাবাসটির জানালার কাচ ভেঙে ফেলে এবং সীমানাপ্রাচীরে আগুন ধরিয়ে দেন। ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাজোমেকে গৃহবন্দী করায় প্যারিসে তাঁর ঘনিষ্ঠ মিত্ররা এই ভেবে ভয় পেয়ে যান যে নাইজারে পশ্চিমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কি না।
এলিসি প্রাসাদ থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বুলিবাগিশ বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘ফ্রান্স ও এর স্বার্থের ওপর কোনো আঘাত বরদাশত করা হবে না।’ তিনি বলেন, ‘যদি কারও গায়ে আঘাত লাগে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো আপস করা হবে না।’ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এই বিবৃতি দুই হাজার মাইল দূরের উপনিবেশের অবাধ্য প্রজাদের উদ্দেশে কোনো এক সাম্রাজ্যবাদী প্রভুর দেওয়া কঠোর হুঁশিয়ারি মতো শুনিয়েছে।
নিয়ামিতে ফ্রান্স দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে যাঁরা রাশিয়ার পতাকা ওড়াচ্ছিলেন, তাঁদের অনেকে বৈশ্বিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মাখোঁর বদলে পুতিনকে বসানোর দাবি জানাচ্ছিলেন। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যদি ঘৃণা তীব্রতর হতে থাকে, তাহলে সেখান থেকে সেনাসহ সব লটবহর গুটিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেটা হলে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল পুরোপুরিভাবে উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
নাইজারে এখনো ফ্রান্সের দেড় হাজার সেনার একটি পুরো গ্যারিসন অবস্থান করছে। এর সঙ্গে জঙ্গি বিমানসহ একটি বিমানঘাঁটি ও ড্রোনও রয়েছে। এ সবকিছুই মনে করিয়ে দেয়, উপনিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার দীর্ঘ ও রক্তাক্ত ইতিহাসের পরও ফ্রান্স গোপনে আফ্রিকায় আধা-ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা চালু রেখেছে এবং সেখানে এখন এমন হুমকির মুখে পড়েছে, যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আগে তারা হয়নি।
নাইজারের বর্তমান সংকটের সঙ্গে ফ্রান্সের আগেকার ঔপনিবেশিক সম্পর্কের যোগসূত্র রয়েছে। উপনিবেশ-উত্তরকালে ফ্রান্স নতুন করে ফ্রঙ্কাফ্রিক ধারণা চালু করে। এর মানে হলো ফ্রান্সের ভাষা ও মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী নব্য-উপনিবেশবাদী প্রভাব বলয় গড়ে তোলা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্সের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রেসিডেন্ট চার্লস দা গল ফ্রঙ্কাফ্রিকের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বে ফ্রান্সের ক্ষমতা এবং আফ্রিকায় ফ্রান্সের ক্ষমতা অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত।’ চার্লস দা গল ও তাঁর উত্তরসূরিরা যখন দেশে দেশে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন, তখনই আবার কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে তাঁদের সামরিক ঘাঁটি ধরে রাখছেন। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের জন্য জ্বালানি সম্পদ ও তাঁদের পক্ষে যায় এমন সব বাণিজ্য চুক্তি তাঁরা বজায় রাখছেন।
ফ্রান্সের নেতারা আফ্রিকাকে ফ্রান্সের বাড়ির পেছনের আঙিনা বলে মনে করেন। নাইজার এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ইউরেনিয়াম উৎপাদনে নাইজার বিশ্বে সপ্তম। আর ফ্রান্স তাদের মোট জ্বালানির ৭০ শতাংশ পারমাণবিক শক্তির ওপর নির্ভরশীল। নাইজারের ইউরেনিয়ামের প্রধান আমদানিকারক ফ্রান্স।
প্যারিসের সামরিক ও সরকারি উপদেষ্টারা নাইজার প্রশাসনে খুব সফলভাবে প্রভাব তৈরি করে আসছেন। তা শুধু বাজোমের সরকার নয়, আগের সব সরকারের ক্ষেত্রেই তা সত্যি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আড়াই কোটি নাইজারবাসীর দাপ্তরিক ভাষা এখনো ফরাসি।
এ ছাড়া ফ্রান্সের সাবেক কলোনিগুলোতে উপনিবেশ-উত্তরকালের শাসন টিকে থাকার অন্যতম ভিত্তি হলো বেপরোয়া দুর্নীতি। নাইজারসহ আফ্রিকায় ফ্রান্সের প্রভাব বলয়ের দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য কুখ্যাত। বিশাল অঙ্কের সহায়তা কর্মসূচির বিনিময়ে সেখানকার আজ্ঞাবহ পুতুল নেতারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়নি। অস্ত্র চুক্তি ও নিরাপত্তা–সহায়তার নামে ঘুষ লেনদেন চলেছে। আর ঘুষের সেই অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।
অবৈধ অর্থের এই লেনদেন সব সময় দুই দিক থেকেই হয়েছে। ফ্রান্সের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের আফ্রিকা থেকেও স্যুটকেসভর্তি টাকা দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি এ ক্ষেত্রে একজন দণ্ডিত অপরাধী। লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। যদিও সারকোজি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
সাব-সাহারা অঞ্চলে ফ্রান্সের মুদ্রা ফ্রাঙ্কের সঙ্গে সম্পর্কিত সিএফএ (আফ্রিকান ফিন্যান্সিয়াল কমিউনিটি) ফ্রাঙ্কের প্রচলন করা হয়েছিল। এখন সেখানে ইউরো চালু আছে। এর ফলে নাইজারসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিকভাবে ফ্রান্স আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।
এই শোষণমূলকব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় সমর্থন জানিয়ে গেছে। এর কারণ হলো, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শীতলযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের এই সাবেক উপনিবেশগুলো ওয়াশিংটনের ভূরাজনৈতিক ও মতাদর্শিক দুর্গ হিসেবে কাজ করত। ফ্রান্সের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আরও অনেক আফ্রিকাবাসীর মতো নাইজারের মানুষেরাও এখন ফ্রাঙ্কাফ্রিক ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করছেন। এর অর্থ হচ্ছে তাঁরা ফ্রান্স সাম্রাজ্যকে প্রত্যাখ্যান করছেন। এই অর্থে বলা যায়, ঐতিহ্যবাহী বলয় হিসেবে পরিচিত আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলে ফ্রান্সের প্রভাব আলগা হয়ে পড়ছে।
গত দুই বছরে উন্নয়ন খাতে দুই বিলিয়ন ডলার সহযোগিতা পাওয়ার পরও নাইজার বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্রতম দেশ। সেখানে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩৭ শতাংশ। ২০২২-২৪ পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন নাইজারের জন্য ৫০৩ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিলেও দারিদ্র্য, তরুণদের বেকারত্ব ও কোভিড মহামারি মোকাবিলার ব্যর্থতার জন্য নাইজারের ওপর ফ্রান্স ও এর মিত্রদের প্রভাবকে দায়ী করা হয়।
ওই অঞ্চলে নাইজার একমাত্র দেশ নয়, যেখানে সামরিক অভ্যুত্থান হলো। ২০২০ সালে মালিতে এবং ২০২১ ও ২০২২ সালে বুরকিনা ফাসোতে দুই দফা সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এই দুটি দেশও ১৯৬০ সালে ফ্রান্সের কাছে থেকে স্বাধীনতা পায়। সবাই বলছেন, ওই অঞ্চলে ফ্রান্সের (প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম) বিরুদ্ধে যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ, সেই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইছে রাশিয়া, তুরস্ক ও চীন।
বুরকিনা ফাসো ও মালির সামরিক শাসকেরা এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে যদি নাইজারে বাজোম সরকারকে ক্ষমতায় ফেরানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়, সেটাকে তাঁরা যুদ্ধের ঘোষণা হিসেবে বিবেচনা করবেন। রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ভাগনার গ্রুপের সেনারা নাইজারের প্রতিবেশী দেশগুলোকে কাজ করছে। এরই মধ্যে তারা নাইজারের বিদ্রোহীদের সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে।
নিয়ামিতে ফ্রান্স দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে যাঁরা রাশিয়ার পতাকা ওড়াচ্ছিলেন, তাঁদের অনেকে বৈশ্বিক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মাখোঁর বদলে পুতিনকে বসানোর দাবি জানাচ্ছিলেন। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যদি ঘৃণা তীব্রতর হতে থাকে, তাহলে সেখান থেকে সেনাসহ সব লটবহর গুটিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। সেটা হলে আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল পুরোপুরিভাবে উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
নাইজার ও আফ্রিকার অন্য দেশগুলো যদি স্বশাসিত সরকার ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের পথে যাত্রা শুরু করে, সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো পথ। কিন্তু এসব দেশে দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সর্বব্যাপী যে অব্যবস্থাপনা, তাতে করে সেখানে নেতৃত্বশূন্যতার পথই তৈরি হবে।
নাবিলা রামদানি আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত ফ্রান্সের সাংবাদিক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে