এই সরকারের যে মান, সে অনুযায়ী গত সপ্তাহটা ছিল নিরুত্তাপ। আর চলতি সপ্তাহে টোরিদের সম্মেলনে চমকপ্রদ কোনো কিছু ঘটবে—এমন আশা নেই। এখন কনজারভেটিভদের নীতি-পরামর্শ ও বক্তৃতা—সবই আগামী নির্বাচনে জয়ের মরিয়া চেষ্টার প্রতিফলন।
সম্প্রতি অভিবাসনের কারণে বহুসংস্কৃতিবাদের চর্চা নিষ্ফল হয়েছে বলে সুয়েলা ব্রেভারম্যান (যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) মন্তব্য করেছেন। তাঁর এ মন্তব্য একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে উচ্চারিত বা এনক পাওয়েলের মতো ভাষা ব্যবহার এমনটা বলাও আর যথেষ্ট নয়। এমনকি কয়েক দশক আগেও কেউ এমন কিছু বলতে পারতেন, তা ছিল অচিন্তনীয়।
ওয়াশিংটনের কিছু ঘাড়গোঁজা বুদ্ধিজীবীর উদ্দেশে সুয়েলা ব্রেভারম্যান এ বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর উদ্দেশ্য, শক্তিধর ও বিত্তশালী ডানপন্থী সংগঠনগুলোর কাছে টোরিদের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে নিজেকে জাহির করা। ‘প্রতিকূল পরিবেশ’, ‘ফিরে যাও’ ভ্যান, ‘অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ’ মগ, ‘ছোট নৌকা’ সপ্তাহ এবং দুই দলের পক্ষ থেকে এমন অগুনতি শব্দ আমরা শুনেছি। সুয়েলা ব্রেভারম্যান এবার আরেক ধাপ এগিয়ে গেছেন।
অভিবাসন মানে লাখ লাখ মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার বেদনা। নতুন দেশে কখনো তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে কেউ, আবার কখনো প্রত্যাখ্যান করেছে। কেউ ভালোবেসেছে, কেউ হৃদয় ভেঙেছে। সন্তানদের জন্ম দিয়েছেন অনেকে। থিতু হয়েছেন, সমৃদ্ধির দেখা পেয়েছেন, সন্ধি করেছেন অনেক বৈপরীত্যের সঙ্গে। তাঁদের প্রত্যেকে সুয়েলা ব্রেভারম্যানের এক অশ্লীল মন্তব্যে সম্মান খুইয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন।
সুয়েলা ব্রেভারম্যান ভবিষ্যতে টোরিদের কান্ডারি হোন বা না হোন, তাঁর এই চরম মনোভাবই দলটি ধারণ করে। তবে ব্রেভারম্যানের ওপর এমন কট্টর অবস্থান নেওয়ার কোনো চাপ নেই। কারণ, রাজনীতির শীর্ষ স্তরে প্রগতিশীল রাজনীতিকদের মধ্যেও অভিবাসীদের সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা কমই আছে। তাঁদের জীবনযাপন যেমন ধারারই হোক, তাঁদের আসলে নিচু করা, হয়রানি বা হতোদ্যম করার কোনো অধিকার কোনো নেতারই নেই। অভিবাসীরা যে শুধু সংখ্যা নয় বরং মানুষ, সে যুক্তি তুলে ধরবেন তাঁরা, তাঁদের সন্তান বা নাতি-নাতনিরা।
এই বক্তব্য গায়ে লাগার মতোই, তবে তা যেন আপনার স্পৃহাকে নষ্ট করে না দেয়। এ বক্তব্য সব পক্ষকে উদ্দেশ্য করে, কেবল বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশান্তরী হয়েছেন—এমন মানুষদের উদ্দেশ্যে নয় (অবৈধ, অভিবাসনপ্রত্যাশী অথবা শুধু নৌকা করে আসা)। এই মানুষগুলো বরাবর সরকারের তীব্র বক্তব্য ও নীতির শিকার হয়ে আসছেন। প্রশ্ন হলো, ব্রেভারম্যানের কাছে ঠিক কোন ধরনের আত্তীকরণ প্রত্যাশিত ছিল?
যুক্তরাজ্যের নাগরিক হতে আমাদের আসলে কী কী বিষয় ছেঁটে ফেলা দরকার ছিল? ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, খাবার, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য? মসজিদ, সিনাগগ বা মন্দিরে যাওয়া ঠিক আছে তো? সহকর্মীদের সঙ্গে পানশালায় না গেলে বা পবিত্র রমজানে রোজা রাখলে, হিজাব পরলে বা কোঁকড়া চুলে বেণি করলে সমস্যা নেই তো? এসব প্রশ্নের কোনো সোজাসাপটা জবাব নেই, শুধু পৌনঃপুনিকভাবে সুয়েলা ব্রেভারম্যান বলে চলেছেন ‘ব্রিটিশ মূল্যবোধের কথা’, মূল্যবোধটা কী, তার আবার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
অভিবাসনের আলোচনায় পবিত্র যে বিষয় বারবার ঊহ্য থেকে যায়, তা হলো একটা নতুন অপরিচিত স্থানকে ‘নিজের বাড়ি’ করে নিতে অভিবাসীদের ঠিক কিসের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এই অভিজ্ঞতা সাধু-সন্ন্যাসীদের অভিজ্ঞতার মতো নয়। নতুন দেশের প্রতি বিশ্বাস থাকতে হয়, অনেক কিছুতে ছাড় দিতে হয়, ছাড়তেও হয়। প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা যদি এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে না–ও গিয়ে থাকেন, তাঁদের সন্তান, তাঁদের নাতি-নাতনিরা একটা জটিল পরিচিতির মধ্য দিয়ে বড় হন। এই পরিচিতিকে শুধু ‘ব্রিটিশ’ বা ‘অব্রিটিশ’—এই ছাঁচে ফেলা যায় না।
অন্য জাতি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা নতুন জীবন বেছে নেন, নতুন করে নানা কাজ করতে শেখেন। যাঁরা এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান, তাঁরা প্রায় অলৌকিক কিছু অনুভব করেন। কড়া অভিভাবকেরাও একসময় অন্য অঞ্চল থেকে আসা নারী-পুরুষের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ককে স্বাগত জানান, যেটা একসময় ছিল চিন্তারও বাইরে।
এমন ঘটনা ঘটে এসেছে বহু বহু বছর ধরে। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন—এমন এক অভিবাসন–বিশেষজ্ঞ রবার্ট উইন্ডার একবার লিখেছিলেন, ‘খাপ খাইয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগে, কখনো কখনো শতাব্দী পেরিয়ে যায়। কিন্তু দেশের যে জমিন, তা ধীরে ধীরে আত্মায় গিয়ে বসত গড়ে।’ এটা একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। মানুষ যখন একা পড়ে যায়, তখন সে বাঁচতে শেখে, মিলেমিশে থাকতে শেখে, যার মূলে থাকে আস্থা আর বিশ্বাস।
এই ঐতিহাসিক দুঃসাহসী যাত্রাকে রাজনীতিবিদদের একটি অংশ বুঝতে চায় না। তারা যখন সবচেয়ে ভালো, তখন তাদের বিশ্লেষণ শীতল ও অস্পষ্ট। আর যখন তারা সবচেয়ে খারাপ, তখন তাদের বিশ্লেষণ নিষ্ঠুর ও অমানবিক। অভিবাসী মানুষ তখন সংখ্যায় নেমে আসেন, অর্থনীতির ক্ষয়িষ্ণু দশা আর অভিবাসীরা সমার্থক শব্দ হয়ে দাঁড়ান। অভিবাসন তখন মানুষের ‘ব্যবস্থাপনা’ ও ‘প্রক্রিয়াকরণে’ আটকে যায়।
এসব বিষবাক্য বর্ষণের পর রাজনীতিকেরা আমাদের বলেন, অভিবাসন ইস্যুতে ভোটারদের মধ্যে যে ভীতি, সে বিষয়ে আমাদের আরও সাবধানী হওয়া প্রয়োজন। অথচ এই ভোটারদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করেন রাজনীতিবিদেরাই। বছরের পর বছর অবৈধ অভিবাসী, তাঁদের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে অবিবেচকের মতো টানাহেঁচড়ার কারণেই ভোটারদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়—এ কথা তাঁরা কখনো ভাবেন না।
সুয়েলা ব্রেভারম্যান রাজনীতিবিদ হিসেবে খুবই প্রয়োজনীয়। কারণ, অদক্ষতার কারণে তিনি যা খুশি তা–ই বলে ফেলেন। অন্যদিকে দক্ষ রাজনীতিবিদেরা বলেন অনেকটা মসৃণভাবে। ব্রেভারম্যানের পরিচয়ের কারণে অনেকেই অভিবাসন নিয়ে তাঁর অবস্থানকে সঠিক মনে করেন। কিন্তু সমস্যাটা তাঁর বৈশিষ্ট্যের কারণে নয়। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবের কারণেও নয়। সমস্যাটার সৃষ্টি হয়েছে এই কারণে যে তিনি নিজেই অভিবাসীর সন্তান। তাঁর এ বক্তব্য বিপজ্জনক, কারণ তিনি যা দাবি করছেন, তা শুধু সংকীর্ণতার পরিচায়ক।
সুয়েলা ব্রেভারম্যান ভবিষ্যতে টোরিদের কান্ডারি হোন বা না হোন, তাঁর এই চরম মনোভাবই দলটি ধারণ করে। তবে ব্রেভারম্যানের ওপর এমন কট্টর অবস্থান নেওয়ার কোনো চাপ নেই। কারণ, রাজনীতির শীর্ষ স্তরে প্রগতিশীল রাজনীতিকদের মধ্যেও অভিবাসীদের সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা কমই আছে। তাঁদের জীবনযাপন যেমন ধারারই হোক, তাঁদের আসলে নিচু করা, হয়রানি বা হতোদ্যম করার কোনো অধিকার কোনো নেতারই নেই। অভিবাসীরা যে শুধু সংখ্যা নয় বরং মানুষ, সে যুক্তি তুলে ধরবেন তাঁরা, তাঁদের সন্তান বা নাতি-নাতনিরা।
আর নয়তো এ বিষয়ে কথা বলবেন গ্যারি লিনেকারদের মতো জনপরিচিত মানুষেরা, যাঁরা চোখে আঙুল দিয়ে এমন ডানপন্থী ভাষ্যের তথ্যগত ভুল শুধু ধরিয়ে দেবেন না, প্রকাশ করে দেবেন ভেতরের শয়তানিটাও।
নেসরিন মালিক গার্ডিয়ানের কলাম লেখক।
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া। ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ।