অনশন সভ্য দেশের সংস্কৃতি। আমাদের দেশ হলো ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশনের’ দেশ। এখানকার মানুষের কাছে মানববন্ধন, অনশন, হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা—এসবের কোনো কদর নেই। এখানে জ্বালাও-পোড়াও, চামড়া তুলে নেওয়া ছাড়া রাজনীতি জমে না। জনসাধারণেরও ধারণা, যাদের তেমন কোনো পেশিশক্তি নেই, তারাই মানববন্ধন করে। সাধারণত দুর্বল রাজনৈতিক দলগুলো নানা ধরনের দাবিদাওয়া নিয়ে অনশনে বসে। বড় দলগুলো করে হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ ইত্যাদি। কথায় কথায় সবকিছু অচল করে দিতে না পারলে ‘কর্তৃপক্ষ’ও কোনো দাবিদাওয়া পূরণ করে না। এমনকি পোশাককর্মীরা রাস্তায় না নামলে বকেয়া বেতন পর্যন্ত দিতে চায় না মালিকপক্ষ। ফলে আপাতনিরীহ এসব প্রতিবাদের তেমন কোনো ফলাফল দৃশ্যমান নয় এখানে।
এখানে পেশিশক্তিতে বলীয়ান লোকেরা ভোটের মাঠেও ভালো ফলাফল করে। ‘জোর যার মুল্লুক তার নীতি’ই এখানকার মূল কথা। অহিংস প্রতিবাদ তাহলে কেন করে মানুষ? আসলে সব মানুষ প্রতিবাদ না করে পারে না। ফলাফল আসুক বা না আসুক, স্বাধীনচেতা মানুষ তার প্রতিবাদ করবেই। সবাই সহিংস হতে পারে না কিন্তু সংঘহীন ব্যক্তিমানুষও সব ঘটনা সহজে মেনে নেয় না। ফলে প্রতিকূলে একাকী দাঁড়িয়ে অহিংস প্রতিবাদও করতে হয় কাউকে কাউকে। সেই প্রতিবাদে ফল হবে কি হবে না, তার চিন্তা না করেই ভেতরের তাগিদে এই মানুষেরা প্রতিবাদ করে। নিজের নৈতিক জায়গা থেকে প্রতিবাদ করে, বুকের ভেতরে পরিবর্তনের ক্ষীণ আশা নিয়ে হলেও প্রতিবাদ করে, অন্যায় সহ্য করতে পারে না বলে প্রতিবাদ করে।
তেমনই একজন মানুষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খান। সারা দেশে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের নিপীড়ন যখন চরমে, তখনই তাঁর প্রতিবাদে অনশনে বসেছেন তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় একপ্রকার ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে ছাত্রলীগ। এর প্রতিবাদ করতেই গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা চত্বরে অনশনে বসেন ফরিদ উদ্দীন খান। তিনি যে প্ল্যাকার্ড নিয়ে অনশনে বসেছিলেন, তাতে লেখা ছিল, ‘শিক্ষাঙ্গনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্রতিবাদে অনশন।’ এই লেখা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থী দুই ধরনের। একদল হলো সাধারণ শিক্ষার্থী আর অন্য অ-সাধারণ দলটি হলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন করা শিক্ষার্থীরা। অন্য কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় তারা এক ও অদ্বিতীয়ভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন তাদের হাতে জিম্মি।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে বারবার খবরের শিরোনাম হচ্ছে এই অ-সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ মাসেই এক শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের পাশাপাশি শিবির আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে ছাত্রলীগের নেতা নাঈম ইসলাম ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায় বলেন, ‘ওই দিন মনে হয়েছিল, আমি কেন হলে উঠলাম। ছাত্রলীগ এমনভাবে কথা বলছিল, যেন আমরা কিছুই না এই জায়গায়। মনে হয় মেরে ফেলবে। কিছুই করার নেই। এটা যেন আর কারও সঙ্গে না হয়, তাই বিচার দাবি করছি। আমার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তার জন্য বিচার চাই।’
তারও আগে হলে থাকার চাঁদা চেয়ে মারধর ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা তাজবিউল হাসানের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন, তাঁর মানিব্যাগ থেকে জোর করে প্রায় চার হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যান তাজবিউল ও তাঁর অনুসারীরা।
শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীরাই যে ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকার হন, তা নয়, খোদ ছাত্রলীগের সদস্যরা পর্যন্ত অভিযোগ করেছেন চাঁদাবাজির, যেখানে অভিযুক্তও ছাত্রলীগের। বাদ যায় না দোকানমালিকেরাও। বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকানের ক্যাশবাক্স থেকে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে শহীদ জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদ মিয়ার বিরুদ্ধে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ধারাবাহিক এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কারও বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, শুধু ওই একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই গত অক্টোবরে আবাসিক হল খুলে দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে হলের কক্ষ দখল, সিটবাণিজ্য, মারধর, চাঁদাবাজি ও হুমকির অন্তত ২০টি অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্রলীগের নির্যাতন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে চার ঘণ্টা ধরে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে নির্যাতনের। এ সময় তাঁকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল ও এই ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এ ঘটনাকে বলেছে ‘বর্বর ও কুরুচিপূর্ণ।’
এ ছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেলে দুজন শিক্ষার্থীকে শিবিরের তকমা দিয়ে রাতভর নির্যাতন করেছে ছাত্রলীগ। এমনকি হাসপাতালে সংকটপূর্ণ অবস্থায় তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, ‘যদি নাম বলিস, তাহলে এখান থেকে আর বের হতে পারবি না।’ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেরে শিবির বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রথা বেশ আগে থেকেই চালু করেছে ছাত্রলীগ। বুয়েটে আবরারকে নির্যাতন করে হত্যার সময়েও এই ধুয়া তুলেছিল তারা।
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজিতে পিছিয়ে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগও। ১৭ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর থেকে বইমেলায় আসা চার ব্যক্তিকে আটকে তাঁদের কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন ঢাবি ছাত্রলীগের পদধারী দুই নেতা মোহাইমেনুল ও রাজীব। মেলার লোকজন তাঁদের হাতেনাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত ১ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪০ দিনের ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডের তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এতে ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২৫টি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো হলো লিখিত অভিযোগের হিসাব। অবশ্যই প্রকৃত ঘটনা এর কয়েক গুণ, যেগুলো নিয়ে অভিযোগ দিতে সাহস পাননি সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যেখানে বিচার পাওয়া যায় না, সেখানে অভিযোগ দেওয়া আর নিজের পায়ে কুড়াল মারার মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই।
এমন পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খান ছাত্রলীগের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এর আগেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে মানববন্ধন, প্রতীকী অনশনে বসেছেন। গত বছরের ২৬ জুন একই চত্বরে নির্যাতনের বিরুদ্ধে অনশন করেন তিনি। কিন্তু প্রশাসন নামক জগদ্দল পাথরকে নাড়ানো যায়নি একচুলও। অহিংস প্রতিবাদ বলেই কি প্রশাসনের কোনো বিকার নেই? এ প্রতিবাদে কারও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, কোনো কিছু বন্ধ থাকছে না, ছেলেমেয়েরা সড়ক অবরোধ করছে না বলেই কি তারা নির্বিকার? অথচ ভারতবর্ষের স্বাধীনতালাভে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল যে সত্যাগ্রহ আন্দোলন, সেটাও কিন্তু অহিংস আন্দোলনই ছিল। প্রতাপশালী ইংরেজ সরকারের ভিত নড়ে গিয়েছিল তাতে।
বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) সকালে অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন খান অনশনে বসার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষকও প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছেন। বিকেলে জোহা চত্বরে বৃহস্পতিবার গিয়ে তাঁরা ফরিদ উদ্দীন খানের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন। অনিয়ম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস কিন্তু বেশ পুরোনো। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ রকম একটা ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে দিনের পর দিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটতে থাকা কোনো শুভ লক্ষণ নয়।
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ছাত্রলীগ তত বেপরোয়া আচরণ করছে। তারা কি ধরে নিয়েছে নির্বাচনে যেহেতু মাঠ দখলের লড়াইয়ে তারাই হবে রাজপথের প্রধান সৈনিক, এ জন্য এখন যা খুশি তা করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? তাদের এই ধরে নেওয়াটা হয়তো আসলেই সত্য এবং ফরিদ উদ্দীন খানের মতো মানুষেরা প্রতিকারের কোনো আশা না দেখেও প্রতিবাদ করছেন।
চোরদের চুরির সাধ এতে মেটে কি না সেটা অবশ্য নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। আপাতভাবে বিষয়টিতে হাস্যরস থাকলেও ফায়েজ মিয়া ধরে নিয়েছেন থানা-পুলিশ করে বা বিচার-সালিস করে ফোন উদ্ধার করা যাবে না। অর্থাৎ তাঁর সমস্যার সমাধান হবে না। আইনি সমাধান পাবেন না বলেই তিনি গালিগালাজ করে মনে ক্ষোভ মিটিয়েছেন।
কেউ কেউ প্রতিকারের আশায় প্রতিবাদ করেন আবার কেউ কেউ প্রতিকার হবে না জেনে প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদের ধরনও হয় জনে জনে আলাদা। ‘দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া’ গিয়ে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ফায়েজ মিয়া সম্প্রতি ‘অভিনব’ প্রতিবাদ করে আলোচনায় এসেছেন। একাধিকবার তাঁর মুঠোফোন চুরি হয়ে যাওয়ায় তিনি তিন দিন ধরে মাইক ভাড়া করে হাটে-বাজারে গিয়ে রীতিমতো অশালীন ভাষায় চোরকে গালিগালাজ করেছেন। তাঁর ভাষ্য হলো, ‘চোরকে যখন ধরতে পারুম না, আবার ফোনও পামু না, তখন মনে হইছে, মন ভইরা বইক্কা লই। কারণ, চোর তো গ্রামের ভেতরেই আছে। আমার বিশ্বাস, এই বকাবকি চোর ও চোরের পরিবারের লোকজনের কানে গেছে। এই বকা হুনার পর ফোন চুরির সাধ মিটব।’
চোরদের চুরির সাধ এতে মেটে কি না সেটা অবশ্য নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। আপাতভাবে বিষয়টিতে হাস্যরস থাকলেও ফায়েজ মিয়া ধরে নিয়েছেন থানা-পুলিশ করে বা বিচার-সালিস করে ফোন উদ্ধার করা যাবে না। অর্থাৎ তাঁর সমস্যার সমাধান হবে না। আইনি সমাধান পাবেন না বলেই তিনি গালিগালাজ করে মনে ক্ষোভ মিটিয়েছেন। যখন মানুষের মনে প্রতিকারের আশা থাকে না, সেই দশাটা কিন্তু ভয়ংকর। মনের ক্ষোভ মেটাতে মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে। ফায়েজ মিয়ার সহিংসতা হলো অশালীন ভাষায় গালিগালাজ।
ফায়েজ মিয়া না হয় প্রকাশ্যে ‘বইক্কা লইতে’ পেরেছেন, মুখে যা আসে তা-ই বলতে পেরেছেন; রুচিগত কারণে সবার পক্ষে এমন প্রতিবাদ সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষের মনের ভেতরের ক্ষোভটা তাতে মিথ্যা হয়ে যায় না।
মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক
[email protected]