শিশুদের শাস্তি দেওয়া অনুচিত এবং শাস্তির বিলোপ প্রয়োজন—এই সাধারণ বিষয় বোঝানোর জন্য বারবার লিখতে হচ্ছে ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়, ক্লান্তি বোধ করি। কিন্তু না লিখেও উপায় নেই। কারণ, সমাজে শিশুদের প্রতি সহিংসতার মধ্যে ‘শাস্তি’ এখন সবচেয়ে ‘গ্রহণযোগ্য’। নো ভায়োলেন্স ইন চাইল্ডহুড প্রকাশিত এন্ডিং ভায়োলেন্স ইন চাইল্ডহুড (গ্লোবাল রিপোর্ট ২০১৭) অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিবছর ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ১৩০ কোটির বেশি শিশু শাস্তির শিকার হয়।
শারীরিক শাস্তি বলতে বোঝায় যেকোনো শাস্তি, যেখানে ব্যথা বা অস্বস্তি তৈরির জন্য শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করা হয়, তা যত হালকাই হোক না কেন। এমন অনেক শাস্তি আছে, যেগুলো ঠিক শারীরিক শাস্তি নয় কিন্তু শিশুর জন্য নির্দয় ও অবমাননাকর। যেমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলা, হুমকি দেওয়া, ভয় দেখানো কিংবা উপহাস করা। সেগুলোও শাস্তির অন্তর্ভুক্ত। শাস্তি শিশু অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘন এবং তাদের মর্যাদার জন্য হানিকর।
শাস্তির ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামগ্রিক বিকাশ ব্যাহত হয়। শাস্তি শিশুদের আগ্রাসী আচরণ ও অপরাধপ্রবণতা বাড়ায় এবং পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১ থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ–পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শাস্তির শিকার হয়েছে। ৩৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন, শিশুকে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন আছে।
বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধ করতে ২০১১ সালে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপরও শিশুরা শিক্ষকদের দ্বারা মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া বাড়ি, প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র ও বিভিন্ন স্থানেই শিশুদের শাস্তি দেওয়া হয়। শরীয়তপুরের একটা শিশুপার্কে টিকিট না কেটে ঢোকায় পাঁচ শিশুকে সবার সামনে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন ইউএনও। এমন খবর কয়েক দিন আগেই গণমাধ্যমে এসেছে।
গ্লোবাল পার্টনারশিপ টু এন্ড ভায়োলেন্স এগেইনস্ট চিলড্রেন প্রকাশিত ‘করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন: সামারি অব রিসার্চ অন ইটস ইম্প্যাক্ট অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েশনস’ (অক্টোবর, ২০২১) জানাচ্ছে, ৩০০টির বেশি গবেষণা প্রমাণ করেছে, শাস্তির ফলাফল বিভিন্ন দিক থেকেই নেতিবাচক।
কোনো গবেষণায় শাস্তির কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। শাস্তির ফলে শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামগ্রিক বিকাশ ব্যাহত হয়। শাস্তি শিশুদের আগ্রাসী আচরণ ও অপরাধপ্রবণতা বাড়ায় এবং পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করে। মা-বাবা এবং শিক্ষকদের শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। তাঁরা যখন শাস্তি দেন, তখন শিশুরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে নির্যাতনকে স্বাভাবিক মনে করে, মেনে নিতে শেখে। আমরা যদি শিশুদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ না করি, তাহলে সহিংসতার চক্র ভেঙে শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।
শিশুদের প্রয়োজন ভালোবাসা ও বয়স অনুযায়ী নির্দেশনা
বাংলাদেশের মা-বাবা, শিক্ষকসহ অনেকের মধ্যেই ভুল ধারণা রয়েছে যে শাস্তি শিশুদের সঠিক আচরণ করতে শেখায়। বড়রা যখন শিশুদের কিছু শেখানোর নামে মারধর অথবা বকাবকি করেন, তখন শিশুরা শুধু শাস্তি এড়ানোর জন্যই কোনো আচরণ করতে শেখে। কিন্তু তারা এর কারণ বুঝতে পারে না। ফলে পরবর্তী সময়ে তারা আগের আচরণের পুনরাবৃত্তি করে। তাই শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি। গত চার দশকের বেশি সময়ের গবেষণা এবং কাজের অভিজ্ঞতায় জানা যায়, শিশুদের সঠিকভাবে বড় করার জন্য প্রয়োজন ভালোবাসা এবং বয়স অনুযায়ী নির্দেশনা, শাস্তি নয়।
আসুন, নিজেদের শৈশবের কথা ভাবি। বড়রা কেমন আচরণ করলে আমাদের ভালো লাগত? এর উত্তরেই বুঝতে পারব শিশুদের সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ করা উচিত। আমরা কি তা করছি?
শাস্তি নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন
শিশুদের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও অনেক দেশে এখনো তথাকথিত ‘শৃঙ্খলা’র নামে শাস্তির বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে আইনের চোখে শিশুদের সমতার অধিকার লঙ্ঘিত হয় এবং এই ভ্রান্ত ধারণা দেয় যে শিশুরা বড়দের অধীন। পৃথিবীর ৬৫টি রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান) শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করেছে। বাংলাদেশ এই তালিকায় নেই।
শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে আইন করতে চাইলে তীব্র বাধা আসে। কেউ কেউ বলেন, অনেক মা-বাবাকে প্রতিকূল পরিবেশে সন্তানদের বড় করতে হয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বেশি ও প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব থাকায় শিক্ষকেরা চাপের মধ্যে থাকতে বাধ্য হন। এসব কারণে তাঁরা শাস্তি দেন। বেশির ভাগ সময়ই শাস্তির ঘটনা ঘটে বয়স্ক ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনের হতাশা থেকে।
বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আরও উপকরণ ও সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু বড়রা জটিলতার সম্মুখীন হলে শিশুদের মারধর বা অপমান করা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। আইন করে সব ধরনের শাস্তি নিষিদ্ধ করলে এ নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটে এবং সময়ের সঙ্গে শাস্তির মাত্রা কমতে থাকে। সুইডেন, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, পোল্যান্ড ও রোমানিয়ায় তা ঘটেছে।
শিশুদের শাস্তি বিলোপে করণীয়
২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশু নির্যাতন অবসানে বিশ্বকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ১৬.২ অর্জন করতে হলে শাস্তি বিলোপ অপরিহার্য। এ জন্য বাংলাদেশে যা করা প্রয়োজন, তা হলো:
১. সব ক্ষেত্রে (বাড়ি, বিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, বিকল্প শিশু পরিচর্যাকেন্দ্রসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান) শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন।
২. নীতিমালা, কর্মসূচি ও জনসচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে আইনি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে এর বাস্তবায়ন যথাযথভাবে হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিতকরণ।
৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শাস্তি নিষিদ্ধকরণে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছে, তার বাস্তবায়ন ও যথাযথ মনিটরিং।
৪. শাস্তি না দিয়ে ইতিবাচকভাবে শিশুদের বড় করা ও শিক্ষাদান সম্পর্কে মা-বাবা এবং শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়ানো। পরিবার ও শিশুদের নিয়ে বা তাদের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সমাজসেবা খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলোতে এ–সংক্রান্ত তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা।
৫. শিশুদের মতামতকে সম্মান করা এবং শাস্তি বিলোপ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে তাদের কথা শোনা।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী