আধুনিক সামষ্টিক বা ম্যাক্রো অর্থনীতির জনক জন মেনার্ড কেইনস বলেছিলেন, ‘আপনার ব্যাংক ম্যানেজার যদি আপনার কাছে এক হাজার পাউন্ড পায়, তাহলে আপনি তার দয়ার ওপর আছেন। আর যদি সেই ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ পাউন্ড হয়, তাহলে সেই ব্যাংক ম্যানেজার আপনার দয়ার ওপর নির্ভর করে আছে।’
বাংলাদেশের চিত্র একটু ভিন্ন। এখানে কেবল ব্যাংক ম্যানেজার নয়, পুরো দেশই ঋণখেলাপির দয়ার ওপর নির্ভর করে আছে। সবাই নির্ভর করে থাকলে দায় এড়ানোর বড় সুযোগ তৈরি হয়। প্রত্যেকেই ভাবেন অন্য কেউ কাজটি করে দেবেন বা কেউ যদি কাজটি না-ও করেন, তাতেও অসুবিধা নেই।
কারণ, নির্দিষ্ট করে কারও দায়ই নেই। এই যেমন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা ২২ মে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ করা এককভাবে ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার দুই দিন পরই বলেছেন, খেলাপি ঋণের সমস্যা সমাধান করতে হবে ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্বকেই। এ জন্য তিনি ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার কথাও বলেছেন।
কে কমাবে খেলাপি ঋণ
গভর্নরের এই বক্তব্যের দুই দিন পরেই জানা গেল, মাত্র তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খেলাপি ঋণ কমানোর যে চ্যালেঞ্জ কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর নিতে বলেছেন, ব্যাংকাররা কি তা নিতে পারবেন? আব্দুর রউফ তালুকদার কিন্তু গত বছরের জুলাইয়ে দায়িত্ব নিয়েই খেলাপি ঋণ বিষয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্তের ভার ব্যাংকের ওপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। এ জন্য আসলেই ব্যাংকিং সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তা কীভাবে সম্ভব হবে।
সার্বিকভাবেই ব্যাংক খাতে সুশাসনের ঘাটতি অনেক প্রকট। ব্যাংক হচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ীর নানাভাবে অর্থ তুলে নেওয়ার মাধ্যম। সরকারের কাছে ব্যাংক দলের কর্মী ও সমর্থকদের সুবিধা দেওয়ার উপায়। আবার বেসরকারি ব্যাংকের কিছু মালিক ও প্রভাবশালীরা যেভাবে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, বিশ্বব্যাংকের বর্ণনায় তা ছিল ‘লাইসেন্স টু লুট’। এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারিও কম। বিশ্বব্যাংক এ কারণেই বলছে, স্বচ্ছতার অভাবে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত অপব্যবহারের বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে। অসংখ্য জালিয়াতির ঘটনা এবং উচ্চ খেলাপি ঋণ এর প্রমাণ।
আমরা জানি, ব্যাংকিং সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করার অন্যতম শর্তই হচ্ছে হস্তক্ষেপমুক্ত ব্যাংক খাত। পরিচালনা পর্ষদের ভূমিকা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও তা মানা হয় না। সরকার একই পরিবারের ৪ জন সদস্যকে ৯ বছর পরিচালক থাকার নিয়ম করে দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। প্রভাবশালীদের ব্যাংক দখলের পৃষ্ঠপোষকও সরকার। আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করেছে, দিয়েছে বিশেষ সুবিধা। এতে খেলাপি ঋণ কেবলই বাড়ছে। আর এখানেই চলে আসে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়।
এখন নতুন উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। শর্ত পূরণ করতে হলেও বড় পরিবর্তন দরকার। ১৯৯৮ সালের পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ব্যাপক সংস্কার করে তাদের ব্যাংক খাতের পুরো খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিল। এরপর আর তাদের পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমান অর্থনীতির সংকটের সময় বাংলাদেশও কি এই সুযোগ নিতে পারবে—এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা
সরকার বনাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বিশ্বজুড়েই একটি জনপ্রিয় বিতর্ক। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, রাজনৈতিক সরকার তাৎক্ষণিক সাফল্য পেতে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নেয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যা ডেকে আনে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ হচ্ছে তা প্রতিহত করা। আর এ কাজ করতে গেলেই দেখা দেয় সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধ ছিল। তুরস্কের এরদোয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরকে জোরপূর্বক বিদায় করেছিলেন। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে টিকতে না পেরে পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) গভর্নর উর্জিত প্যাটেল।
এ বিষয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাটি বলেছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডি সুব্বারাও। ২০১৩ সালে ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন পি চিদাম্বরম। প্রবৃদ্ধি বাড়াতে তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদহার কমাতে বলেছিলেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল বলে ডি সুব্বারাও নীতি সুদহার কমাতে মোটেই রাজি ছিলেন না। তখন চিদাম্বরম বলেছিলেন, ‘প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিতে যদি সরকারকে একা হাঁটতে হয়, তাহলে একাই হাঁটব।’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডি সুব্বারাও বলেছিলেন, ‘আমার আশা, একদিন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বলবেন, আমি প্রায়ই রিজার্ভ ব্যাংকের কাজে হতাশ হই।
এতই হতাশ হই যে মনে হয় আমি হাঁটতে বের হব, এমনকি যদি একাই হাঁটতে হয়, তাতেও সমস্যা নেই। কিন্তু একই সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাংকের অস্তিত্ব আছে বলে ঈশ্বরকেও ধন্যবাদ দেব।’ আসলে সুব্বারাও কথাটা ধার করেছিলেন জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডারের একটি উক্তি থেকে। শ্রোয়েডার একবার বলেছিলেন, ‘আমি প্রায়ই বুন্ডেস ব্যাংকের কাজে হতাশ হই। কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তাদের অস্তিত্ব আছে।’ অর্থাৎ ভালো রাষ্ট্রনায়কেরা যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাকে মেনে নিয়েই কাজ করেন, সে কথাই সুব্বারাও বলেছিলেন।
কতটা সুরক্ষা দেবেন গভর্নর
কিছুদিন আগেও অনেকেই বাংলাদেশ ব্যাংককে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদপ্তর বলতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল কাজই ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পালন করা। আবার এমন উদাহরণও আছে যে অর্থ মন্ত্রণালয় যেসব নির্দেশ দিয়েছিল, তা প্রস্তুত করেছিল প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদেরই একটি অংশ।
নতুন গভর্নর আসার পর এখন বাংলাদেশ ব্যাংককে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধিদপ্তর কেউ বলছেন না। বরং উল্টোটাই বলার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। এখন দৃশ্যত অর্থনীতি বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নরই প্রধান ব্যক্তি। আর সবকিছুর ঊর্ধ্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তো আছেই। এ অবস্থায় গভর্নরের কাছে একটু বেশি প্রত্যাশা করাই যায়।
দেশে ব্যাংক দখলের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে। এর পর থেকে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। মালিকদের চাপে তখন একাধিক এমডি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা সভা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সুরক্ষা চেয়েছিলেন, কিন্তু পাননি। এরপরও একাধিক ব্যাংকের এমডিকে সরে যেতে হয়েছিল।
তবে সব ব্যাংকেই যে মালিকদের হস্তক্ষেপ কমেছে, তা বলা যাবে না। সুতরাং সবার জন্য সমান নীতি বজায় রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই সুরক্ষাই যথেষ্ট নয়। ব্যাংকিং সংস্কৃতি গড়ে তুলতে ছোটখাটো উদ্যোগ, প্রতিশ্রুতি বা নির্দেশে তেমন কাজ হবে না। কিছু লোককে শাস্তি দিতে হবে, কিছু মানুষকে ব্যাংক খাত থেকে দূরে রাখতে হবে।
আর ব্যাংক যাতে নিয়মনীতির মধ্যে থাকে, সেই নজরদারি করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আসলে দরকার বড় পরিবর্তন। এই পরিবর্তন আসতে হবে সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে। নীতিনির্ধারণে যেহেতু গভর্নর এখন জোরালো ভূমিকা রাখছেন, কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেনও, সে কারণেই প্রত্যাশা একটু বেশি। সুতরাং ব্যাংক সংস্কৃতি পরিবর্তনে গভর্নর কী ভূমিকা রাখবেন, সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ব্যাংক খাত নিয়ে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, যা এখন প্রায় ২০ শতাংশ।
এখন নতুন উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেড়েছে। শর্ত পূরণ করতে হলেও বড় পরিবর্তন দরকার। ১৯৯৮ সালের পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের সময় পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ব্যাপক সংস্কার করে তাদের ব্যাংক খাতের পুরো খোলনলচে পাল্টে দিয়েছিল। এরপর আর তাদের পেছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমান অর্থনীতির সংকটের সময় বাংলাদেশও কি এই সুযোগ নিতে পারবে—এটাই এখন বড় প্রশ্ন।
শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন