সবকিছু চোখে দেখার পরই বিশ্বাস করতে হয় বলে আমাদের যা শেখানো হয়েছিল, তা এখন অচল হয়ে গেছে। ‘আমরা কোনো কিছুই কি আর দেখে বিশ্বাস করতে পারব না?’ (ক্যান উই নো লঙ্গার বিলিভ এনিথিং উই সি?) শিরোনামে নিউইয়র্ক টাইমস ৮ এপ্রিল একটি প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদনে অনেক ছবি আছে। একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন নাচছেন। ছবিটি বিশ্বাসযোগ্য। কিন্তু ছবিটি কম্পিউটারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) তৈরি। তারও কয়েক দিন আগের কথা।
নিউইয়র্কের আদালতে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আগের কথা। তাঁর বর্তমান আবাস ফ্লোরিডায় মার-এ লাগোতে এফবিআই বিভিন্ন গোপন নথির সন্ধানে যখন তল্লাশি চালায়। সেদিনেই ছবি ছড়িয়ে পড়ল যে এফবিআইয়ের সদস্যরা তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নিউইয়র্কের আদালতে হাজিরা দেওয়ার আগেই ছবিটা টুইটারে আট লাখ মানুষ দেখেছে। বিবিসির ডিজইনফরমেশন ওয়াচ ছবিটি ভুয়া এবং এআই দিয়ে তৈরি বলে চিহ্নিত করে।
এ তো গেল ছবির কথা। কিন্তু ১১ এপ্রিল আরও এক ধাপ এগোনোর খবর দিয়েছে বিবিসি। তা–ও সেটি পাশ্চাত্যের কোনো দেশ নয়, আরব দেশ, কুয়েতের। কুয়েতে টেলিভিশনে খবর পড়তে দেখা গেছে এআই–সৃষ্ট এক নারীর ভিডিওতে। আপনি ভিডিওতে একজন মানুষকে মুখ নাড়তে দেখছেন, চোখে-মুখে নানা রকম অনুভূতি প্রকাশ করতে দেখছেন। কিন্তু সংবাদ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর যদি আপনাকে বলা হয় যে এতক্ষণ যাঁর ভিডিও দেখেছেন, তিনি অশরীরী। অনেকেরই তখন অজ্ঞান হওয়ার দশা হতে পারে, বিশেষ করে যাঁরা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন।
ভুয়া সংবাদের বিরুদ্ধে লড়াইটা কত কঠিন হয়ে উঠছে, এগুলো হচ্ছে তার কয়েকটি খণ্ডচিত্র। এআই নিয়ে অনেকেই আতঙ্কিত এবং এর উন্নয়নে রাশ টেনে ধরার আওয়াজ উঠেছে খোদ প্রযুক্তি খাতের দানবাকৃতির প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। তাদের মধ্যে মতভেদ এবং বিভাজনও আছে। টুইটারের ইলন মাস্ক যেমন এর রাশ টানার পক্ষে, তেমনি মাইক্রোসফটের বিল গেটস এখনই কোনো নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নন। সরকারগুলোও বিষয়টির নীতি তৈরিতে গুরুত্ব দিয়ে বিতর্ক ও সলাপরামর্শে ব্যস্ত। চীন ঘোষণা করে দিয়েছে, তাদের দেশে বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠান এআই নিয়ে কাজ করতে চাইলে আগে তার একটা সরকারি নিরীক্ষা হবে।
বিদ্যানন্দের অডিট প্রতিবেদন তাদের ওয়েবসাইটে আছে। কিন্তু সেগুলোর আরও অধিকতর নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তাদের পরিচালনা পরিষদ বা ট্রাস্টি কারা, কী তাদের পরিচয়, সেসব বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই। অনাথ বাচ্চাদের জন্য সাহায্য চাইতে বাচ্চাদের ছবি যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা কি শিশু আইনের অনুমোদনযোগ্য? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের দায়িত্বের মধ্যেই তো পড়ার কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের মতোই আমাদের রাজনীতিতে বিভাজন তীব্র। সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবির মতো এ দেশেও কোনো রাজনীতিবিদের বানোয়াট ছবি দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা অসম্ভব নয়। বিশেষ করে বিভিন্ন ওপেনসোর্স এআই অ্যাপ এখন যেভাবে সহজলভ্য হয়ে গেছে এবং আসন্ন নির্বাচনের আগে সেগুলোর যে আরও উন্নতি ঘটবে, তাতে সন্দেহ নেই। নিউইয়র্ক টাইমস যে অ্যাপ ব্যবহার করে বানোয়াট ছবি বানিয়েছিল, সেটি হচ্ছে মিডজার্নি। তারা ভুয়া ছবি চিহ্নিত করার কৌশল নিয়েও আলোচনা করেছে। যেসব ছবি তারা বানিয়েছে, সেগুলোর হাত নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে তা কৃত্রিম, মানবীয় নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এতটা সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। ফলে, ভুয়া ছবি ও খবর মোকাবিলা এখন মূলধারার সংবাদমাধ্যমের জন্য যে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ভুয়া ছবির বিষয়ে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে গেটি ইমেজ। তারা এ রকম এআই–নির্ভর ছবি তৈরির টুল স্ট্যাবিলিটি ডিফিউশনের স্বত্বাধিকারী কোম্পানি স্ট্যাবিলিটি এআইয়ের বিরুদ্ধে ১ কোটি ২০ লাখ ছবি বেআইনিভাবে কপি করার অভিযোগ এনে মামলা করেছে। কোম্পানিটি যে এআই টুল তৈরি করেছে, সেই টুলের প্রশিক্ষণের জন্য এসব ছবি সংগ্রহ করেছে। এ রকম মামলা হচ্ছে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির তরফ থেকে তাদের লোগো ও ব্র্যান্ডের সুনাম সুরক্ষার জন্য।
তথ্যের সত্যতা যাচাই সব সময়েই সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
কিন্তু এখন সে দায়িত্ব নতুন মাত্রা পেয়েছে এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভুয়া তথ্য চিহ্নিত করার সক্ষমতা অর্জন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফরাসি বার্তা সংস্থা বিডিফ্যাক্টচেক নামে একটি সেবা শুরু করেছে। ফেসবুক ও গুগলও ভুয়া তথ্য ও ছবি যাচাইয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এই ফ্যাক্টচেকিং বা সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আরও কিছু উদ্যোগ এখন বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছে, যাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও যোগসূত্র নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ফেসবুক হ্যাকার হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের প্ল্যাটফর্মে নিষিদ্ধ করেছে—এমন কয়েকজন ফ্যাক্টচেকিংয়ের কাজ শুরু করায় এ আশঙ্কা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
সাইবার জগৎ বা অনলাইন হচ্ছে এখন প্রচারের নতুন যুদ্ধক্ষেত্র। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কিছু ভাইরাল হতে সময় লাগে না এবং ভাইরাল হলে তা সমাজ ও রাজনীতিতে যে কতটা আলোড়ন তৈরি করে, তার অভিজ্ঞতা আমাদের কম হয়নি। তবু আমরা যথেষ্ট সতর্ক বলে মনে হয় না। রাজনৈতিক বিভাজনের প্রভাব সমাজে যেভাবে স্থায়ী রূপ নিয়েছে, তাতে সামাজিক মাধ্যমের যেকোনো বিতর্কেও তার প্রতিফলন পড়তে বাধ্য।
সাম্প্রতিক বিদ্যানন্দ–বিতর্কের কথাই এখানে উল্লেখ করা যায়। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ঘটনাটি ফেসবুকে উত্তাপ যতটা ছড়িয়েছে, মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তা ততটাই উপেক্ষিত থেকেছে। পক্ষে-বিপক্ষে যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিচয় নিয়েও কথা উঠেছে। আমাদের দেশে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কি এসব বিতর্কে কোনো ভূমিকা নিতে পারে? স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রশ্নে সংবাদমাধ্যমের নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে কিছু দায় আছে। কেননা, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রসার ও প্রচারে তারাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিদ্যানন্দের অডিট প্রতিবেদন তাদের ওয়েবসাইটে আছে। কিন্তু সেগুলোর আরও অধিকতর নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তাদের পরিচালনা পরিষদ বা ট্রাস্টি কারা, কী তাদের পরিচয়, সেসব বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই। অনাথ বাচ্চাদের জন্য সাহায্য চাইতে বাচ্চাদের ছবি যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা কি শিশু আইনের অনুমোদনযোগ্য? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের দায়িত্বের মধ্যেই তো পড়ার কথা। তাদের সব কাজের জবাবদিহি চাওয়ার অধিকার সাধারণ মানুষের রয়েছে। বিতর্ক তৈরি হওয়ার পর তা অনিষ্পন্ন থাকলে প্রতিষ্ঠানেরই ক্ষতি হয়, যা কারোরই কাম্য নয়।
বিশ্বের বিখ্যাত কিছু দাতব্য সংস্থার ক্ষেত্রেও অর্থের নয়ছয়, কর্তাদের জবাবদিহিতে অনীহা এবং যৌন অপরাধের মতো অভিযোগ অতীতে উঠেছে। অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেনের মতো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কেলেঙ্কারির মুখে পড়েছে। এমনকি জাতিসংঘকর্মীদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু সেগুলোর নিষ্পত্তি হয়েছে তৃতীয় পক্ষকে স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে দেওয়ার মাধ্যমে। ওই সব ক্ষেত্রেও সংবাদমাধ্যমগুলোর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সত্য যাচাই কঠিন হওয়ার কালে সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে আমাদের দেশেও সংবাদমাধ্যমের কাছে ব্যতিক্রম কাম্য নয়।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক