ভ্লাদিমির পুতিন ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসেই যে বিষয় স্পষ্ট করেছিলেন, সেটি হলো, তিনি বরিস ইয়েলৎসিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভ—এই দুই পূর্বসূরির তুলনায় নিজেকে অন্তত সন্ত্রাস মোকাবিলা ইস্যুতে একেবারে আলাদা চেহারায় দাঁড় করাবেন।
সন্ত্রাস প্রতিরোধ ইস্যুতে চাপের মুখে কখনোই নত হবেন না বলে পুতিন প্রথম থেকেই যে দৃঢ় সংকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তাঁর স্বাতন্ত্র্য প্রতিফলিত হবে।
কেজিবিতে প্রশিক্ষিত অনেক কর্মকর্তার মতো একজন কর্মকর্তা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে আঘাত পাওয়া একজন নেতা হিসেবে পুতিন প্রথম থেকেই বিশ্বাস করে এসেছেন, রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়া এতটাই নাজুক যে শত্রুদের এক ইঞ্চি ছাড় দেওয়া হলে তার জের ধরে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে।
১৯৯৫ সালে একটি হাসপাতালে জিম্মি করা লোকদের জীবন বাঁচানোর জন্য জিম্মিকারী নেতার সঙ্গে ফোনে ইয়েলৎসিনের প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর চেরনোমিরদিন বুদিওনোভস্কের দেনদরবার করেছিলেন।
সন্ত্রাসীদের সঙ্গে চেরনোমিরদিনের সেই বিখ্যাত ফোনকল পুতিন ও তাঁর কেজিবির সহকর্মীদের কাছে সন্ত্রাস মোকাবিলার নিকৃষ্টতম পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা চেরনোমিরদিনের ফোনকলের পর সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আপসরফা হয়।
তার সুবাদে জিম্মি হওয়া রুশ নারী ও শিশুদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে প্রথম চেচেন যুদ্ধের অবসান ঘটে। এটিকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর জন্য অবমাননাকর ঘটনা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
পুতিনের নীতিতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এ ধরনের সমঝোতার কোনো স্থান নেই। সেই ঘটনার পরের বছরগুলোয় তিনি প্রতিটি নতুন সন্ত্রাসী হামলার পর যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে তাঁর বা তাঁর সংস্থাগুলোর ওপর জনসাধারণের চাপ দেওয়া অসম্ভব ছিল।
রাশিয়ায় যখনই কোনো সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে, তখনই পুতিন ঘটনাসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রকাশ-প্রচারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছেন।
২০০২ সালের অক্টোবরে মস্কোর একটি থিয়েটার হলে সহস্রাধিক লোককে জিম্মি করার পর সেখানে জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এফএসবি) যে অভিযান চালিয়েছিল, আমি সেই অভিযানের ধরন নিয়ে সমালোচনা করে একটা লেখা লিখেছিলাম।
এর জের ধরে আমার বিরুদ্ধে এফএসবি তদন্তে নেমেছিল। এফএসবির ওই বিশেষ জিম্মি উদ্ধার অভিযান শেষ হয়েছিল ১৩০ জনের বেশি জিম্মির প্রাণহানির মধ্য দিয়ে। যাঁরা মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়েছিল সন্ত্রাসীদের কাবু করতে এফএসবির ব্যবহার করা গ্যাসের কারণে।
শত্রুদের এক ইঞ্চিও ছাড় না দেওয়ার যে প্রত্যয় পুতিন ধারণ করছিলেন, সেই প্রত্যয় থেকেই তিনি বরিস ইয়েলৎসিনের ১৯৯৮ সালে জারি করা সন্ত্রাস মোকাবিলা আইন বাতিল করে তার স্থলে নতুন আইন চালু করেছিলেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত সেই প্রত্যয় বেশ জোরালো ছিল।
ইয়েলৎসিনের ১৯৯৮ সালের আইনে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হলে তা মোকাবিলায় জোর দেওয়া হয়েছিল। আর পুতিন তার স্থলে যে নতুন আইন জারি করেন, সেখানে রাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে চালানো সন্ত্রাসবাদের ওপর জোর দিয়েছিল।
সোজা কথায়, সন্ত্রাসীরা বেসামরিক মানুষকে জিম্মি করলে সেটিকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে দেখার ওপর পুতিন জোর দিয়েছেন। এতে জিম্মিদের প্রাণ রক্ষার চেয়েও সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
রাশিয়ার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো পুতিনের পয়েন্টটি ধরতে পেরেছিল। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও ধরতে পেরেছিল। ১৯৯০ ও ২০০০–এর দশকের প্রথম দিকে সন্ত্রাসীরা বেসামরিক লোককে জিম্মি করত, যাতে ক্রেমলিনকে আলোচনায় বাধ্য করে রাজনৈতিক দাবি আদায় করে নেওয়া যায়।
কিন্তু সন্ত্রাসীরা যখন বুঝতে পারল, তারা কাউকে জিম্মি করে কোনো দাবি করলে পুতিন তাতে সাড়া দেবেন না, তখন তারা নৃশংস ও হিতাহিতজ্ঞানশূন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পথ বেছে নেয়। উত্তর ককেশাসের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো রাশিয়ার একজন নিরাপত্তাকর্মীকে হত্যা করে এ ধারার ‘উদ্বোধন’ করে।
এরপর তারা মস্কোর একটি বিমানবন্দরে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে এবং বিভিন্ন গণপরিবহনে হামলা চালাতে শুরু করে।
পুতিন খুবই নিয়মতান্ত্রিক ব্যক্তি। তিনি তাঁর শাসনামলজুড়ে তাঁর সংস্থাগুলোর ভাবমূর্তি রক্ষা করার নীতিতে অটল। তিনি তাঁর দীর্ঘতম ও প্রিয়তম ‘বিনিয়োগ’ কেজিবি ও এফএসবিতে সব ধরনের সম্পদের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করেছেন।
এসব সংস্থাকে যেকোনো সমালোচনা থেকে বাঁচিয়ে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে আসছেন। এই নীতি প্রধান নিরাপত্তা সংস্থা এফএসবির সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এফএসবি দমন-পীড়নে অত্যন্ত দক্ষ ও উদ্ভাবনী সংস্থা হয়ে উঠেছে।
এর ধারাবাহিকতায় আজ রাশিয়ার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো হত্যা ও নির্যাতনের ‘বিশেষজ্ঞ’ হয়ে উঠেছে।
রাশিয়ান সমাজ এর সাম্প্রতিক অনেক উদাহরণ দেখেছে। যেমন গত ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী রাজনীতিক অ্যালেক্সি নাভালনির কারাবন্দী অবস্থায় মৃত্যু, রাজনৈতিক বন্দীদের দুর্দশা, গত মাসে স্পেনে একজন রাশিয়ান দলত্যাগীর নিহত হওয়া ইত্যাদি।
ভিডিও নজরদারি ও মুখাবয়ব শনাক্তকরণ প্রযুক্তির বদৌলতে এফএসবি এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ।
কিন্তু সম্ভাব্য আরও হামলা ঠেকাতে এসব খুব একটা কাজ করবে না। কেননা, তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সাফল্যের জন্য প্রধানত যা প্রয়োজন, তা হলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় পরিমণ্ডলের গোয়েন্দাদের সঙ্গে তথ্যের আদান–প্রদান, এসব সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক আস্থা থাকা এবং বড় কোনো অস্বস্তিদায়ক খবরও কর্মকর্তাদের এমনকি নেতাদের জনগণের কাছে বলতে পারার সৎসাহস থাকা।
মস্কোর এই সর্বশেষ হামলার ঘটনায় তারা হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া অন্তত ৪ জনকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধাওয়া করে ধরে ফেলেছে। প্রায় নিশ্চিতভাবেই এসব সন্দেহভাজন আসামিকে হেফাজতে নির্যাতন করা হয়েছে।
একসময়ের ক্রেমলিনপন্থী একটি সংবাদমাধ্যমের ফাঁস করে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আটক হামলাকারীদের একজনের কান কেটে সেই কাটা কান তাকে খেতে বাধ্য করেছেন এফএসবির কর্মকর্তারা।
কিন্তু সম্ভাব্য আরও হামলা ঠেকাতে এসব খুব একটা কাজ করবে না। কেননা, তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের সাফল্যের জন্য প্রধানত যা প্রয়োজন, তা হলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় পরিমণ্ডলের গোয়েন্দাদের সঙ্গে তথ্যের আদান–প্রদান, এসব সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক আস্থা থাকা এবং বড় কোনো অস্বস্তিদায়ক খবরও কর্মকর্তাদের এমনকি নেতাদের জনগণের কাছে বলতে পারার সৎসাহস থাকা।
যেহেতু রাশিয়ায় ব্যক্তিস্বাধীনতা নেই, যেহেতু সেখানে রাজনৈতিক আলাপ–আলোচনা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, সেহেতু এখানকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর মানুষের আস্থা অনেক কম।
● আন্দ্রেই সোলদাতোভ নির্বাসিত রুশ লেখক ও দ্য কম্যাট্রিয়টস: দ্য রাশিয়ান এক্সাইলস হু ফট এগেইনস্ট দ্য ক্রেমলিন বইয়ের লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ