ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোনো এক গ্রামে এক যৌনপল্লি। সেখানকারই কিশোরী লতি জানালা দিয়ে গোলাকার চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে আনমনে, বিস্ময়ে। কারণ মাস্টার মশাই বলেছেন, চাঁদে যাচ্ছে মানুষ। একবার রাস্তায় দেখা হলে কোটের পকেট থেকে দুমড়ানো-মুচড়ানো পত্রিকার অংশ বের করে দেখিয়েছেন—ভুলোক থেকে চন্দ্রলোকের দিকে পদক্ষেপ।
নগেন স্যার ক্লাসে চন্দ্রাভিযানের গল্প করেন। সহপাঠী এসে লতিকে সেসব বলে যায়। আর চাঁদের সামনে মুখ করে লতি ভাবতে থাকে, চাঁদে যাবে মানুষ, কীভাবে সম্ভব? তার মা রজনী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তার জন্য ‘বাধা বাবু’ ঠিক করেছে। রজনী চায় না তার মতো মেয়ের জীবনটাও এই ‘নরকে’ শেষ হয়ে যাক। কিন্তু মাস্টার মশাই লতির চোখে যে স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন, সেখানেই যে তার বসবাস।
মাস্টার মশাই আসা যাওয়ার পথে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে লতি। অনেকবার বলেকয়ে তাদের ঘর যৌনপল্লিতে নিয়ে যায়। মাস্টারমশাইও রজনীকে অনেক অনুরোধ করে, লতিকে স্কুলে পাঠাতে। এত ভালো মাথা মেয়েটার, ক্লাস সিক্সে প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। কিন্তু রজনী রাজি হয় না।
মাস্টার মশাই জানান, তিনি পরের সপ্তাহে কলকাতায় আরেক স্কুলে চলে যাচ্ছেন, নয়তো জোর করে লতিকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। এও অনুরোধ করেন, তাঁর কোনো ছেলে-মেয়ে নেই, লতিকে যেন তাঁর কাছে দেন, কলকাতা নিয়ে যাবেন। ওর এত জানার আগ্রহ, এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? রজনীর মা কড়া মুখে মাস্টারমশাইকে না করে দেন। আর পেছনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট লতি যেন পাথরের দেওয়ালের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল। বাধা বাবুর কাছেই কি তবে যেতে হবে তাকে? নগেন স্যার মুখ কালো ফিরে যাওয়ার সময় বললেন, মানুষ চাঁদে পৌঁছে গেছে, তোলপাড় হবে সারা পৃথিবী। তখন যেন নড়ে ওঠল সেই দেয়াল।
বাধা খদ্দরের কাছে পাঠানোর জন্য লতিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দিচ্ছিলেন রজনী। সেসময় যৌনপল্লিতে ঘটল খুন। চারদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। চকমকে নতুন শাড়ি পরা লতিও দিল দৌড়। স্টেশনে ছেড়ে দিয়েছে রেলগাড়ি। দৌড়ে দৌড়ে খুঁজে নিল মাস্টারমশাইকে। চোখে তীব্র স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মাস্টারমশাইর সাথে ছুটল সে নতুন গন্তব্যে।
ভারতের চন্দ্রাভিযানের খবর কানে আসতেই সেই লতির কথাই মনে পড়ল সবার আগে। মন্দ মেয়ের উপাখ্যান সিনেমার লতির গল্প এভাবেই চিত্রিত করেছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, আমার প্রিয় একজন নির্মাতা। মূলত প্রফুল্ল রায়ের একটি ছোটগল্পের উপর ভিত্তি করে এই সিনেমার নির্মাণ। শেষ দৃশ্যে ট্রেন ছুটে যায়, পর্দায় দেখা যায় চাঁদের উদ্দেশ্যে ছুটছে রকেট। চাঁদের দিকে মানুষের এ যাত্রা যেন ভারতের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক কিশোরীরই অভিযাত্রা। চন্দ্রযান-৩ এর দলে ছিলেন বেশ কয়েকজন নারী বিজ্ঞানীও। তাঁদের ভিড়ে আমি যেন সেই লতিকেই খুঁজে পাই। যে কী না নগেন স্যারের দেওয়া পুরস্কার গ্লোব নিয়ে খেলতে খেলতে পৃথিবীকে ভালোবাসতে শিখেছিল আর চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেখানে মানুষের পদচারণার ছবি নিজের মধ্যে এঁকেছিল।
ভারতের অভূতপূর্ব এই মহাকাশ বিজয় গোটা পৃথিবীকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে আমাদেরও। ভারত মাত্র আটশো কোটি টাকায় চন্দ্রবিজয় করতে পারল, আমরা কেন পারলাম না। অথচ তার চেয়ে বেশি টাকা আমাদের কয়েক কিলোমিটার রাস্তা বানাতেই খরচ হয়ে যায়। বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব কেন একজন আমলার হাতে থাকবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব নিয়ে তুমুল বিতর্ক আমরা দেখলাম। আমলাকেই কেন সেখানে নিয়োগ দেওয়া হয়, তা সুলুক সন্ধান না করে, স্পারসোর চেয়ারম্যানকে চরমভাবে কী তুলোধুনোই না করা হলো। ভাবুন তো, রাস্তার পেছনে খরচ করা সেই টাকা দিয়ে চাইলেই কি আমাদের চন্দ্রাভিযানে যাওয়া সম্ভব?
ভারতের এই সফল চন্দ্রাভিযান এই প্রশ্নও তৈরি করেছে, কী করে এত অল্প খরচে এটি সম্ভব হলো? এর পাল্টা একটি প্রশ্ন, এটি কি শুধু আটশো কোটি টাকার প্রজেক্ট ছিল? আক্ষরিক অর্থ সেটি সত্য হলেও, এর পেছন দেখলে বাস্তবতা তা বলে না। বিজ্ঞান ও গবেষণায় ভারতের গত প্রায় ৭০ বছরের বিনিয়োগের ফসল নয় কি এটি? এর জন্য একের পর এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। বাইরে চলে যাওয়া মেধাবীদের দেশে ফিরে আসার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। যখন যে সরকারই আসুক না কেন, সেসব প্রতিষ্ঠানকে আরও বেশি সবল করা হয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হয়েছে শত শত বিজ্ঞানী, নিজেদের প্রযুক্তি নিজেরাই গড়েছেন তাঁরা। তবে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ বলা যায় শিক্ষাব্যবস্থায়। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে অনেকগুলো প্রজন্ম।
প্রজন্ম গড়ার বড় বুনিয়াদ হচ্ছে স্কুল শিক্ষা। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে দরকার যোগ্য শিক্ষক। গুগলে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করেই জানতে পারলাম, ভারত মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষকদের জিডিপির ১৭৩ শতাংশ বেতন দেয়, যা এশিয়াতে দ্বিতীয়। সরকারি স্কুলের একজন শিক্ষকের বছরে বেতন দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ডলার।
এবার বাংলাদেশের স্কুলশিক্ষকদের অবস্থা তুলনা করুন। দেশের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক তারা। সরকারি, এমপিও, নন-এমপিও—নানাভাবে বৈষম্য জারি করে রাখা হয়েছে আরও। ফলে একটি সচ্ছল জীবনের আশায় প্রয়োজনীয় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধাদির দাবিতে হাজার হাজার শিক্ষককে ক্লাস বাদ দিয়ে আন্দোলনে নামতে হয়, দিনের পর দিন ঢাকায় পড়ে থাকতে হয়। দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে তাদের আবার ক্লাসেও ফিরে যেতে হয় আবার।
আমাদের শিক্ষা খাতের বরাদ্দের বড় একটি অংশই চলে যায় অবকাঠামো তৈরিতে, যেখানে অনেক ভবনই আবার পড়ে থাকে। আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মানে এখনো বুঝে থাকি ভবন তৈরি করা বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা। গণতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা—এসব যে আমাদের এখানে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় হয়ে ওঠতে পারল না, তার ফলই রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে আমাদের ভুগতে হচ্ছে।
একইভাবে খাটে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটগুলোর ক্ষেত্রেও। দেশটি ২৩টি বিশ্বমানের আইআইটি তৈরি করেছে, যেগুলোর পর্যায়ে আমাদের পঞ্চাশটির অধিক কোনো বিশ্ববিদ্যালয় যেতে পারেনি। জেলায় জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হচ্ছে ঠিকই, সেগুলোর আদৌ উপযোগিতা আছে কী না, সেই ভাবনাও আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে নেই?
ভারতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউটের পিএইচডি ইউরোপ–আমেরিকায় গ্রহণযোগ্য হয়। আমাদের এখানে সেটি কল্পনা করা যায় এখনো? কেন করা যায় না, তা আন্তর্জাতিক র্যাংকিংগুলোতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থানই বলে দেয়।
ভারতে বাজেট শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়তে থাকে, আর আমাদের কমতে থাকে। আমাদের শিক্ষা খাতের বরাদ্দের বড় একটি অংশই চলে যায় অবকাঠামো তৈরিতে, যেখানে অনেক ভবনই আবার পড়ে থাকে। আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা মানে এখনো বুঝে থাকি ভবন তৈরি করা বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা। গণতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা—এসব যে আমাদের এখানে এখনো প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় হয়ে ওঠতে পারল না, তার ফলই রাজনৈতিক, সামাজিক এমনকি পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে আমাদের ভুগতে হচ্ছে।
তবে এটি ঠিক, সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে বিজেপি আমলে গণতান্ত্রিক ভারত কিছুটা হলেও হোঁচট খেয়েছে। নগেন স্যারের ভারতে তৃপ্তি ত্যাগী নামে স্কুল শিক্ষিকারও আমরা দেখা পাই। চন্দ্রযান-৩ এর সাফল্য উদ্যাপনের পরপরই উত্তর প্রদেশে একটি স্কুলে এক মুসলিম শিক্ষার্থীকে চড় মারার কাণ্ডও আলোচনায় আসে। শিক্ষক তৃপ্তি ত্যাগীর নির্দেশে ক্লাসরুমের সব শিক্ষার্থী ওই মুসলিম সহপাঠীকে চড় মারে। এ নিয়ে গোটা ভারতে তোলপাড় তৈরি হলেও এ ঘটনায় অনুতপ্ত নন ওই শিক্ষিকা। সংখ্যালঘু ও জাতিগত বিদ্বেষ ও সহিংসতা ভারতীয় সমাজে নানা বদল ঘটালেও দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তি এখনো কিছুটা হলেও অটুট আছে, সেটিই আসলে ভারতের শক্তি। সেই শক্তি বলেই আজকের ভারতের চন্দ্রবিজয়।
অনেকে এমন প্রশ্নও করে থাকেন, বাংলাদেশকেও কেন চাঁদে যেতে হবে? তাহলে এ প্রশ্নও করতে হয়, আমাদের কেন তাহলে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠাতে হলো, তাও বিপুল খরচ ও আয়োজন করে। এখানে রাজনৈতিক বিষয়–আশয় থাকলেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, মহাকাশ গবেষণার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, একটি দেশ বা জাতি বিজ্ঞান গবেষণায় কতটা এগিয়েছে।
শেষ করব, দুই বছর আগের রাজশাহীতে আমাদের সহকর্মী আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদের করা একটি খবর নিয়ে—‘হতে চেয়েছিলাম পাইলট, কিন্তু বিয়ে হয়ে গেল’। বিদ্যালয় ছেড়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসা এক শিক্ষার্থীর ফেলে যাওয়া খাতায় ছিল এ লেখাটি। বড় বোনের বাতিল সেই খাতায় বেশির ভাগ পাতা ছিল সাদা। সেই খাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে এসেছিল ছোট ভাই।
খবরে প্রকাশিত হওয়া খাতাটির ছবি আর সেই লেখাটি এখনো চোখে ভাসে। নবম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় ওই ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই বয়সে সে যে স্বপ্ন দেখেছিল, তার বয়সী বেশির ভাগ শিশু-কিশোরই তা দেখে না। আমাদের মেয়েদের বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়, আমাদের ছেলেরা পেটের দায়ে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে কারখানার আগুনে পুড়ে কয়লা হয়। তখন আমার একজন নগেন স্যারের কথা মনে পড়ে।
ফলে বিজ্ঞান-গবেষণায় উন্মুখ প্রজন্ম তৈরি করতে যে দাবি, তা পূরণে অসংখ্য নগেন স্যারের প্রয়োজন, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি কখনো? অনেক জায়গাতে, অনেক দিক দিয়ে আমরা অবশ্যই এগিয়ে গিয়েছি, তারপরেও কোথাও যেন একটা আফসোস থেকেই যায়।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
ই–মেইল: [email protected]