ইসরায়েল আজ পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগী নিরীহ শিশু ও নারী। বিশ্বের সব দেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা গণহত্যার অভিযোগে ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে তুলেছে। গাজা সংকট মধ্যপ্রাচ্যে বানের স্রোতের মতো নতুন একগুচ্ছ সংকটের দুয়ার খুলে দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য হুতিদের ওপর হামলা শুরু করেছে। আর লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ইরান–সমর্থিত হুতিরা গাজা যুদ্ধকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।
লোহিত সাগর যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সংঘাতের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এখানেই থামছে না। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড করপসের প্রধান কাসেম সোলাইমানির স্মরণ অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়েছে আইএসআইএস। ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলা চালিয়ে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছিল।
এর প্রতিক্রিয়ায় সিরিয়ায় কুর্দি ব্যবসায়ীর বাড়িতে হামলা করে ইরান। তারা দাবি করেছে, বাড়িটি ইসরায়েলি গুপ্তচরদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। উত্তর সিরিয়ার ইদলিবের একটি চিকিৎসাকেন্দ্রেও তারা হামলা করেছে।
এ ঘটনাগুলো ঘটার কারণ হলো আইএসআইএস নামের যে সংগঠনকে নিশ্চিহ্ন করতে পশ্চিমা দেশগুলো উদ্গ্রীব, তারাই এখন পশ্চিমাদের শত্রুদেশে হামলা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার ঝুঁকি বেড়েই চলেছে এবং কে কার শত্রু, সেটা বোঝা যাচ্ছে না।
তুরস্ক এই সমস্যাগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তুরস্কের জনগণ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আরও বাস্তবধর্মী কর্মপদ্ধতি দরকার হয়।
ন্যাটোর দুই সদস্য তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের একে অন্যের সঙ্গে বিরোধ রয়েছে। এই বিরোধ একটি দ্বিধা সামনে নিয়ে আসে। ন্যাটো জোট যদি কারও সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক কি একসঙ্গে সেই লড়াইয়ে অংশ নেবে। সব বিষয়ে একমত না হলেও ওয়াশিংটন ও আঙ্কারার একটি যৌথ রূপরেখা তৈরি করা প্রয়োজন। তাদের তৃতীয় কোথাও একসঙ্গে বসা উচিত। কিন্তু সেটা হতে দেখা যাচ্ছে না।
ইরাক ও সিরিয়ায় যে সন্ত্রাসের জন্ম হচ্ছে, সেটা নির্মূল করার বিকল্প নেই তুরস্কের। কয়েক দশক ধরে তুরস্ক সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া তুরস্কের পক্ষে সেটা করা অসম্ভব।
তুরস্কের নিজেদেরই সমস্যা রয়েছে। কিন্তু অংশীজনদের কাছাকাছি নিয়ে আসার ব্যাপারে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে দেশটি। এ ধরনের উদ্যোগে আঞ্চলিক প্রভাব আছে এমন দেশ, যেমন রাশিয়া, ইরাক, সিরিয়া ও ইরানও যুক্ত হতে পারে। সবাই স্বতন্ত্র উদ্যোগ নিতে পারে, একে অন্যকে হুবহু নকল করার প্রয়োজন নেই।
কুর্দি সমস্যা মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি মাথাব্যথার কারণ। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর বিপরীত শিবিরে অবস্থান করলেও দুই পক্ষই কুর্দি ইস্যুতে সমর্থন দেয়। মস্কো বারবার বলে চলেছে, যাতে সিরীয় কর্তৃপক্ষ তাদের সেনাবাহিনীতে আলাদা একটা ব্রিগেড হিসেবে কুর্দি যোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করে চলেছে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব দিকে সিরিয়ার ভূখণ্ডে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত একটি অঞ্চল তৈরি করার জন্য।
ইরাক ও সিরিয়ায় যে সন্ত্রাসের জন্ম হচ্ছে, সেটা নির্মূল করার বিকল্প নেই তুরস্কের। কয়েক দশক ধরে তুরস্ক সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া তুরস্কের পক্ষে সেটা করা অসম্ভব।
মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাচিন্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হলো ইসরায়েলের নিরাপত্তা। এই বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির মূল স্তম্ভ হলো ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি থেকে সরে আসবে, এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররা ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া থেকে সরে আসবে না।
যদিও তুরস্ক খুব প্রবলভাবে সুন্নি পক্ষপাতের দেশ নয়। ফলে তুরস্কের সুন্নি ও শিয়া দেশগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতা করার একটা সুযোগ আছে। কিন্তু আঙ্কারার বর্তমান সরকারকে সেই ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো লোহিত সাগর ও বাব এল–মান্দেব প্রণালির অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠা। মধ্যপ্রাচ্যে যখন একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখন ইরান সেটাকে হুতিদের উসকানোর সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছে।
লোহিত সাগরের এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে যদি ঠিকভাবে মোকাবিলা না করা যায়, তাহলে এই উত্তেজনা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য জায়গায়ও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি সুয়েজ খালে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যকে এখন অনেকগুলো সংকটের প্রসূতি বলে মনে হচ্ছে।
● ইয়াসার ইয়াকিস তুরস্কের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত