আমাদের উঠতি তারুণ্যে মুক্তি পেয়েছিল বলিউডের সিনেমা গ্যাংস্টার। তখন সিডি–ভিসিডির যুগ। আমাদের জেমস সেই সিনেমায় গান গেয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। ফলে অনেক কসরত করে সিনেমাটি দেখা হয়েছিল। গ্যাংস্টার দেখতে গিয়েই প্রথম আমাদের চোখে আটকান কঙ্গনা রনৌত। মূলত সেটিই ছিল তাঁর বলিউডে প্রথম পা রাখা।
সেই থেকে শুরু, শুরুর কিছু দিন বাদ দিলে একের পর এক সিনেমা দিয়ে বাজিমাত করেন তিনি। কিং–খান–বাদশাহদের বলিউডে হয়ে ওঠেন ‘কুইন’। কিন্তু তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকতে চান না। প্রত্যক্ষ–পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে জড়ালেন তিনি। বারবার বিতর্কিত ও সমালোচিত হলেন। তখন অন্যদিকে একের পর এক ফ্লপ সিনেমাই তিনি উপহার দেন।
সিনেমা যত ফ্লপ হতে থাকে তিনি আরও তত বিজেপি–ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন, কৃষকনীতি ও রামমন্দির ইস্যুতে অন্যান্য বলিউড তারকাকেও ছাপিয়ে যান কঙ্গনা। তাঁর পুরস্কার হিসেবে বাগিয়ে নেন এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির টিকিট।
প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই জয় পেয়েছেন। তাহলে কি তিনি পুরোপুরি রাজনীতিতেই থিতু হচ্ছেন, ছাড়ছেন বলিউড? এমন আলোচনার মধ্যেই খেয়ে বসলেন এক কৃষককন্যার চড়। যে চড়ে উঠে আসছে তাঁর পুরোনো সব খতিয়ান। সাম্প্রতিক তাঁর সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম থালাইভি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এখানে। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি।
গত বৃহস্পতিবার চণ্ডীগড় বিমানবন্দরে কর্মরত কুলবিন্দর কৌর নামের এক নারী কনস্টেবল কঙ্গনাকে চড় মেরে এখন বাহবা কুড়িয়ে যাচ্ছেন। ভিডিওতেই তাঁকে বলতে দেখা যায়, কৃষক আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের কঙ্গনা অপমান করেছিলেন। কুলবিন্দর সেই নারীদেরই একজনের সন্তান। কঙ্গনার প্রতি ক্ষোভ পুষে রেখেছিলেন তিনি, সুযোগ পেয়ে সেটিরই প্রকাশ ঘটালেন তিনি।
বলা হচ্ছে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা পয়েন্ট পার হওয়ার সময় নিয়ম অনুযায়ী ট্রেতে মুঠোফোন রাখতে অস্বীকৃতি জানান কঙ্গনা; বরং তিনি নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের ধাক্কা দিয়ে চলে যেতে চেষ্টা করেন। তখন এই চড়ের ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় কুলবিন্দরকে সাময়িক বরখাস্ত ও আটক করা হয়েছে। যদিও কুলবিন্দর চাকরির পরোয়া করেন না বলে দিয়েছেন। হাজারটা চাকরি গেলেও কৃষক মায়েদের অপমানের শোধ নেওয়ার পক্ষেই তিনি।
থালাইভিতে কঙ্গনাকে বলতে শোনা যায়, এ লড়াই জনগণের জন্য...নিজেদের আত্মসম্মানের জন্য। আর আমরা দেখলাম, কঙ্গনাকে চড় দিয়ে সেই আত্মসম্মানবোধেরই প্রকাশ ঘটালেন কুলবিন্দর। মোদির বিতর্কিত নীতির বিরুদ্ধে কৃষক সমাজের যে লড়াই, সেটিকেও তিনি ভুলে যাননি।
পাঞ্জাবের কৃষক সমাজও তাদের এই কন্যাকে নিয়ে গর্বিত। কুলবিন্দরের ভাইও কৃষকদের একটি সংগঠনের নেতা। পাঞ্জাবের এক ব্যবসায়ী তো কুলবিন্দরের জন্য লাখ রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করেছেন। কেউ দিয়েছেন চাকরির প্রস্তাব।
স্বাভাবিকভাবেই একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির গায়ে হাত তোলায় ‘মহা অন্যায়’ করেছেন। তা ছাড়া যেকোনো একজন ব্যক্তির গায়ে হাত তোলা বা আঘাত করা ফৌজদারি অপরাধও। তার ওপরে অন্যায়কারী ব্যক্তি যদি হন আইনের মানুষ, তাঁর অপরাধ সমাজ বা মানুষের কাছে আরও বড় হয়ে ধরা দেয়। ফলে তাঁকে সমর্থন করার কিছু নেই।
কিন্তু কৃষককন্যার আত্মমর্যাদার প্রশংসা করতেই হয়। সেখানেই তিনি ‘কুইন’। তবে কৃষককন্যা যেন এখানের অনেকের মনোবাসনা পূরণ করলেন। কিন্তু কঙ্গনাকে চড় মারার মনোবাসনা কেন থাকবে মানুষের? বলা যায়, সেটি তিনিই মানুষের ভেতরে ধীরে পয়দা করে দিয়েছেন।
বিজেপির চরম জাতীয়তাবাদী ও ধর্মবাদী রাজনীতির ‘পোস্টার গার্ল’ হয়ে উঠেছিলেন যেন তিনি। না হলে তিনি কী করে বলেন, ১৯৪৭ সালে ভারত যে স্বাধীনতা পেয়েছে, সেটা আসলে ভিক্ষার সমান, প্রকৃত স্বাধীনতা এসেছে ২০১৪ সালে! মানে যখন থেকে বিজেপি টানা শাসন শুরু এবং ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা। এভাবে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে অপমানজনক বক্তব্য করতে ন্যূনতম দ্বিধাবোধ করেননি তিনি।
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সেই অঞ্চলকে গোটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল বিজেপি এবং চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটাল। শুধু তা–ই নয়, দ্য কাশ্মীর ফাইলস নামে প্রোপাগান্ডামূলক সিনেমা বানিয়ে তাঁদের সেই কর্মকাণ্ডকে দুনিয়াবাসীর কাছে বৈধতা আদায়েও সচেষ্ট হলো। আর সেই সিনেমা নিয়ে বিতর্ক ও সমালোচনা উঠল, তখনো কঙ্গনা বিজেপি নেতাদের থেকে এক কাঠি সরেস। সিনেমাটি নিয়ে চুপ থাকা বলিউড তারকাদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘তাদের সময় শেষ!’
নির্বাচনে বিরোধী জোটের দিকে জোয়ার ওঠায় নরেন্দ্র মোদি তখন ভোটের মাঠে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে নিজেকে একপ্রকার ঈশ্বরই ঘোষণা করলেন। তবে তারও আগে নিজ আসনে নির্বাচনী জনসভায় কঙ্গনা মোদিকে হিন্দু দেবতা ‘রামের বংশধর’ ঘোষণা দিয়ে বসেন। এর আগে বাবরি মসজিদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত রামমন্দির উদ্বোধনে যোগ দিয়ে কঙ্গনা বলেছিলেন, ‘রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা হোক।’
এভাবে একের পর এক মন্তব্য করে সমালোচিত হয়েছিলেন কঙ্গনা। বিজেপির নেতা–কর্মীরাও চটেছিলেন তাঁর ওপরে মুম্বাইকে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর বলায়। আর কৃষক আন্দোলনে ১০০ রুপির বিনিময়ে নারীরা অংশ নিয়েছিলেন বলে যে মন্তব্য করেছিলেন, সে কারণে শেষমেশ চড়ই খেয়ে বসলেন।
শুধু তা–ই নয়, সেসব নারীদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে তিনি নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে শাহিনবাগের বিখ্যাত দাদি বিলকিস বানুকেও আক্রমণ করেন। এসব মন্তব্যে তিনি অনেক মানুষের মনে আঘাতই দিয়েছেন। অথচ থালাইভিতে তাঁর একটি ডায়ালগ ছিল এমন—এমন কিছু বলুন যা হৃদয় ছুঁয়ে যায় ... এবং যা হৃদয়ে আঘাত করে না।
সিনেমাটিতে নারীর অসম্মান নিয়েই সোচ্চার ছিলেন জয়া চরিত্রে অভিনয় করা কঙ্গনা। তামিলনাডুর জনপ্রিয় নেত্রী জয়ললিতার বায়োপিক এ সিনেমায় মূল চরিত্রে কঙ্গনার যে ভূমিকা, যে ডায়ালগ—সবই যেন তাঁর ব্যক্তি নিজের বিরুদ্ধেই যায়।
তবে একটি জায়গায় মিল বলতেই হবে, জয়ললিতা যেমন সিনেমার হিরোইন থেকে রাজনীতিতে চলে এসেছিলেন, কঙ্গনার ক্ষেত্রেও তা–ই। যদিও দুজনের রাজনীতিতে আসার পথ ও পরিস্থিতি পুরোপুরিই আলাদা।
আরও একটি মিল বলা যেতে পারে, সিনেমায় দেখা যায়—বিধানসভায় ধাক্কাধাক্কি–চড়–মারধরে অপমানিত হয়ে জয়া চরিত্রের কঙ্গনা শেষমেশ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সেখানে ফেরেন। আর বাস্তবে কঙ্গনা লোকসভার এমপি হয়েই চড়টা খেলেন।
তবে অপমানিত হয়ে ‘জয়া’ হয়ে উঠেছিলেন জনগণের নেত্রী, শুধু তাই নয় ‘আম্মু’ সম্বোধনেই জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সেই চরিত্রে অভিনয় করা কঙ্গনা এখন কত দূর যাবেন, সেটিই হলো প্রশ্ন।
যেভাবে জয়ার মুখে শোনা যায়, ‘এই লড়াইয়ে আমরা পড়ে যেতে পারি, আহত হতে পারি; কিন্তু পিছু হটতে পারি না’, সেই রাজনীতির স্পৃহা কি আদৌ ধারণ করেন কঙ্গনা? কৃষককন্যার চড় তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
এমনকি এটিও হতে পারে, সেই কুলবিন্দরই পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন কঙ্গনাকে। ভারতের রাজনীতি তো এমনই বৈচিত্র্য আর বৈপরীত্যে ভরা।
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী।
ই–মেইল: [email protected]